রাজশাহী এবং সাউথইষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে(প্রেষণে)র অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান এবং ফার্মাসিষ্ট ডঃ মামুনুর রশিদ স্যারের সাথে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল সাইয়েন্সে গবেষণা আর আনুষঙ্গিক বিষয়ে সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন আলী আসিফ
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনার গবেষক হওয়ার অনুপ্রেরনা আসল কোথায় থেকে?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ আমি তখন স্কুলের ছাত্র, নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ি। রসায়ন ল্যাবের ব্যাবহারিক এর কাজ করতে গিয়ে প্রথম আগ্রহ জন্মে গবেষণার উপর। গবেষনার কাজ বড় আকারে করার সুপ্ত বাসনা মনের গহীনেই ছিল । মাস্টার্স পর্যায়ে থিসিসের কাজ, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদানের পরপরই আমার পছন্দের বিষয়- কার্ডিওভাস্কুলার ফার্মাকোলজির প্রতি আগ্রহ ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠে। এই বিষয়ের উপর পড়াশোনা ও উচ্চতর গবেষণা করার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান আছে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনার গবেষণালব্ধ বিষয় সম্পর্কে যদি আমাদের পাঠকদের নিকট আলোকপাত করেন।
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ সেরেটনিন 5-HT2A রিসেপ্টরের অ্যাক্টিভেশন এর মাধ্যমে বিভিন্ন কার্ডিওভাস্কুলার রোগের উৎপত্তি ঘটে। সারপগ্রেলেট নামক একটি নতুন ধরনের 5-HT2 এন্টাগনিস্ট ল্যাবে সিন্থেসিস করা হয়। আমি তিন ধরনের মানব 5-HT2A , 5-HT2B , 5-HT2C ক্লোনিং করে মলিকুলার মডেলিং এর মাধ্যমে সারপগ্রেলেট এর সাথে বাইন্ডিং সাইট চিহ্নিত করি । দেখা যায় যে, সারপগ্রেলেট 5-HT2Aএর সাথে বেশিমাত্রায় বাইন্ড করে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করি যে, সারপগ্রেলেট 5-HT2Aরিসেপ্টরকে ইনহিবিশনের মাধ্যমে নানাবিধ কার্ডিওভাস্কুলার রোগ প্রতিরোধ করে। এই গবেষণাটি পি এইচ ডি তে করি যা পরবর্তীতে Life science Journal(2009) and Journal of Pharmacology and Therapeutics (2004)এ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পোস্ট ডক গবেষণায় রক্তের কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ স্ট্যাটিনের প্লিওগ্রাফিক ইফেক্ট এর সঠিক ম্যাকানিজম অব অ্যাকশন বের করি। সঠিক মাত্রার স্ট্যাটিন প্রয়োগে দেখতে পাই যে, ইহা Rac1 প্রোটিনকে ইনহিবিট করে প্লিয়ট্রপিক ইফেক্ট প্রদান করে। এই গবেষণার কাজটি আমি সার্কুলেশন জার্নাল (২০০৯) এবং ট্রেন্ডস ইন ফারমাকলজিকাল সায়েন্স(২০০৭)এ প্রকাশ করি। বর্তমানে আমি কার্ডিয়াক রিমডেলিং এর উপর গবেষণার কাজ করে যাচ্ছি।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ পি এইচ ডি গবেষণা জীবনের কোন স্মরণীয় ঘটনা……
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ ২০০১ সালের কথা, পি এইচ ডি তখন মাঝপথে। এমন সময় জানতে পারলাম জাপানের সেন্দাইতে ড্রাগ অ্যাকশনের উপর সিম্পসিয়াম হতে যাচ্ছে। সেখানে অংশগ্রহন করে পোস্টার প্রেজেন্টেশান দিলাম। দিন শেষে শ্রান্ত দেহ যখন বিশ্রাম খুঁজছে, সেই স্মরণীয় সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম শ্রেষ্ঠত্তের পুরস্কারে আমার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। উৎসাহ ও উদ্দীপনায় কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে গেলাম, পরক্ষনে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলাম। পুরস্কার গ্রহনের সময় বক্তব্য রাখতে বলা হল। আমার সাথে সাথে আমার দেশের নাম বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে পেরে আনন্দে মনটা ভরে উঠল ।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ জাপানে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুপ্রেরনা…।
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ দেশ এবং জন্মভূমির প্রতি যে কমিটমেন্ট তা পূরণ করতেই দেশে ফিরে আসি। জাপানে অর্জিত জ্ঞান আমাদের দেশের তরুন প্রজন্মের মাঝে বিলিয়ে দেবার জন্য অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজ করে যাচ্ছি।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনার মতে বাংলাদেশের ফারমাসিউটিক্যাল রিসার্চ এর অবস্থা কেমন ?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃউন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করলে আমাদের অবস্থা ততটা উজ্জ্বল নয়। তবে পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে এই ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। আমাদের সীমিত সম্পদ এবং নানাবিধ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ফারমাসিউটিক্যাল রিসার্চ ভাল অবস্থানে উঠে আসছে। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। সুতরাং, সেদিকটিও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনি কি মনে করেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এর সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত থাকা উচিত?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ অবশ্যই। উন্নত দেশগুলোতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পারস্পরিক কোলাবোরেশনের মাধ্যমে গবেষণা করে রোগের কারন অনুসন্ধান, ঔষধের কার্যকারিতা নির্ণয় ইত্যাদি কাজ করে থাকে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের দেশে সেই প্রচলনটা এখনও তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। ঔষধ কোম্পানিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ফান্ড দিলে যেমন দেশেই ভাল মানের কাজ হবে, তেমনি শিক্ষার্থীরা দেশেই ভাল মানের পিএইচডি কিংবা পোস্ট ডকের কাজ করে ঔষধ শিল্পে নতুনত্ব আনায়নের মাধ্যমে এই খাতকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ বাংলাদেশের ফার্মা সেক্টরের চাকরি কিংবা গবেষণার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আপানার ভাবনা ?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ যেখানে বিশ্বের নানা দেশ যেমন, জার্মানিতে ৯৫% ফার্মা জব কমিউনিটিকে কেন্দ্র করে, সেখানে আমাদের দেশে এখনও আমাদের দেশে ফার্মাসেক্টরের চাকরীটা প্রধানত ঔষধ কোম্পানি কেন্দ্রিক। হসপিটাল ফার্মেসী, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী কিংবা কমিউনিটি ফার্মেসীর মত ক্ষেত্রগুলো চালু করা গেলে ফার্মা চাকরীর ক্ষেত্রটা আর বড় করা সম্ভব।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনি একই সাথে একজন একাডেমীসিয়ান-গবেষক এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। কোন দায়িত্বটা বেশি উপভোগ করেন এবং কেন ?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ একাডেমীসিয়ান হিসাবে যখন দেখি আমার ছাত্রছাত্রীরা দেশে- বিদেশে ভাল করছে তখন ভাল লাগে, একাডেমীসিয়ান হিসাবে নিজেকে সফল মনে হয়। গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন কিছুর আবিষ্কার, রোগের কিংবা রোগ প্রতিরোধের কারন আবিষ্কার করতে পারি তখন ভাল লাগে। আবার বিভাগীয় প্রধানের জায়গা থেকে বললে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা একটা চ্যালেঞ্জ । যেমন, নানাবিধ জটিলতা সমাধান করে প্রশাসন সচল রাখা, সেশনজট নিরসন করা, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ছাত্রছাত্রীদেরকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া- এগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারার মধ্যেও এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ তরুণ শিক্ষার্থীরা যারা গবেষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তাদের প্রতি আপনার উপদেশ ?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ তরুণদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, রিসার্চে ক্যারিয়ার গঠন করা একটি মহৎ পরিকল্পনা। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হতে হবে। পর্যাপ্ত পড়াশোনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশিতব্য আর্টিকেলগুলো ভাল ভাবে পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং নিজের গবেষণার বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে। গবেষণার পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য আধুনিক পদ্ধতি, প্রক্রিয়া আর যন্ত্রপাতি গুলি ভালভাবে চালনা করতে জানতে হবে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ ফার্মাসিস্টদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতে চান ?
অধ্যাপক ডঃ মামুনুর রশীদ ঃ ফার্মেসী বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর সকল শিক্ষার্থী নিজেকে ফার্মাসিস্ট হিসাবে ভাবেন। সেই ভাবনার সাথে চেতনারও মিল থাকা চাই। সেবার যে ব্রত বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় বাস্তব জীবনে তার চর্চা থাকতে হবে। মানুষ, সমাজ সর্বোপরি দেশের স্বাস্থ্যসেবার কল্যাণে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে নিজেকে সর্বদা সেবাকল্পে নিয়োজিত রাখতে হবে।
Share3