সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশ এবার কথা বলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সালেহ হাসান নকীব স্যারের সাথে। অধ্যাপক নকিব ছাত্রদের ভোটে নির্বাচিত বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, এস এন নাহার ফিজিক্স রিসার্চ এ্যাওয়ার্ড ২০১৪ বিজয়ী। এর আগে Physical Sciences Category তে ২০০৭ সালে Young Scientist হিসেবে TWAS (The World Academy of Sciences, ITALY) Award পেয়েছেন বাংলাদেশ থেকে।স্যারের অভিজ্ঞতা আর মতামত থেকে নবীন গবেষকরা উপকৃত হবেন বলে আমরা আশাবাদী। সায়েন্টিফিক বাংলাদেশের পক্ষে স্যারের সাথে কথা বলেছেন ডঃ মুনির উদ্দিন আহমেদ।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার শিক্ষা ও গবেষণা জীবন নিয়ে কিছু বলুন।
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ আমার বাবা এবং মা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। আমার নানা দাদাও শিক্ষকতা করেছেন। আমি তৃতীয় প্রজন্মের শিক্ষক। তো যে কথা বলতে চাইছি, ছোটবেলা থেকেই বইপত্রের মধ্যে বড় হয়েছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে শিক্ষা জীবনের শুরু। মধ্যে কয়েকটি বছর কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে কেটেছে। কলেজ জীবন কেটেছে রাজশাহী কলেজে। পড়তাম প্রচুর, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে মন ছিল না। কলেজ জীবন পর্যন্ত কলা ও বিজ্ঞান দুটোই আকর্ষণ করত। ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি এবং দর্শনও খারাপ লাগত না। এর ফলে অনেকটা দোদুল্যমান অবস্থায় এইচএসসি পাশ করি। জীবনের বড় অংশ রাজশাহীতে কেটেছে। বাবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন, কাজেই রাজশাহীতেই যে পড়ব তা এক রকম ঠিকই ছিল। কি পড়ব তা নিয়ে অবশ্য কোন পরিষ্কার ধারণা ছিল না। পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হই বাবার ইচ্ছায়। সে সময় আমার কাছে অর্থনীতি, ইংরেজি, গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান একই রকম ছিল। প্রথম বর্ষের শুরুতে Properties of Matter বলে একটি কোর্স ছিল। দুয়েকটি ক্লাস করতেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রেমে পড়ে যাই। আজ প্রায় আড়াই দশক পর এই পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি সহসা জাগা সেই ভালবাসাকেই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে মনে হয়। পদার্থবিজ্ঞান সকলের জন্যই একটি কঠিন বিষয়। কিন্তু ভালো লেগে গেলে পরিশ্রম সহজ হয়ে যায়। শেখা এবং বোঝার আনন্দ অতুলনীয়।
এমএসসি শেষ হওয়ার আগেই ইটালিতে অবস্থিত নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালামের প্রতিষ্ঠিত ICTP (International Centre for Theoretical Physics)-তে কন্ডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সে DICTP কোর্সের জন্য মনোনীত হই। কিছু দিন পর SIUC (Southern Illinois University, Carbondale, USA)-এ প্রফেসর ফজলে বারি মালিকের তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্য নির্বাচিত হই। আমেরিকাতে আমার গবেষণা বিষয় ছিল Colossal Magnetoresistivity। যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশী দিন থাকি নি। ১৯৯৮-এর অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন কমনওয়েলথ স্কলার হিসেবে, উচ্চ-তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী, কিউপ্রেট (cuprate) সিস্টেমের উপর প্রফেসর জন কুপারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করি। এমএসসি পর্যায়েও দেশে আমার গবেষণা ক্ষেত্র ছিল সুপারকন্ডাক্টিভিটি। আসলে আমার এমএসসি প্রজেক্টটিই ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অতিপরিবাহিতা নিয়ে প্রথম কাজ। আমার সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর এ কে এম আজহারুল ইসলাম। এরই ভেতর ১৯৯৭-সালের মাঝামাঝি প্রভাষক পদে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করতে হয়েছিল। আসলে সেই ১৯৯৬ থেকে কিউপ্রেট সিস্টেমে অতিপরিবাহিতা আমার প্রধান গবেষণার বিষয়। কেম্ব্রিজে পিএইচডি শেষে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে অবস্থিত MacDiarmid Institute for Advanced Materials and Nanotechnology-তে প্রফেসর জেফ ট্যালনের সাথে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করি। এরপর আবার কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের কোয়ান্টাম ম্যাটার গ্রুপে গবেষক হিসেবে ছিলাম বেশ কিছু সময়। ২০০৫-এ দেশে ফিরে আসি। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর আমন্ত্রিত গবেষক হিসেবে কোয়ান্টাম ম্যাটার গ্রুপের সাথে কিছু সময় কাটিয়েছি। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ICTP-এর রেগুলার অ্যাসোসিয়াট হিসেবে কাজ করেছি।
কিউপ্রেট সিস্টেমে সুডোগ্যাপ (pseudogap) বলে একটি বিষয় আছে। কিউপ্রেট অতিপরিবাহিতার শুরু সেই ১৯৮৬ সালে। গত ত্রিশ বছর ধরে কিউপ্রেটের ফিজিক্স পদার্থবিজ্ঞানীদের ভুগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো সিস্টেমটিকে বুঝতে পারি নি। অনেকেই মনে করেন, সুডোগ্যাপ বুঝতে পারলে কিউপ্রেট অতিপরিবাহিতা বোঝা যাবে। সেই ১৯৯৮ থেকে সুডোগ্যাপ নিয়ে কাজ করছি। ২০০৩ এবং ২০০৫ সালে সুডোগ্যাপ নিয়ে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধের কথা মনে হলে ভালো লাগে। প্রবন্ধ দুটির সাইটেশন দুই শতের মত। অতি পরিবাহিতা ছাড়াও কিছুদিন থেকে DFT (Density Functional Theory) ব্যবহার করে অন্যান্য কিছু সিস্টেমের উপর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
নিজেকে পদার্থবিজ্ঞানের এক নগন্য ছাত্র ছাড়া আর কিছু কখনো মনে হয়নি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই – কোন অব্যাখ্যাত কারণে তিনিই বিষয়টির প্রতি আমার মনে তীব্র কৌতূহল সৃষ্টি করেন। পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই আছি। আমার স্ত্রী নিজেও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে কিউপ্রেট সিস্টেমের অতিপরিবাহিতা নিয়ে পিএইচডি করেছেন। তিনিও বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ কি কারনে শিক্ষকতা এবং গবেষণায় আসলেন?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ– আসলে শিক্ষকতা এবং গবেষণায় অতি সামান্য দক্ষতা ছাড়া আমার আর কোন যোগ্যতা নেই। কাজেই শিক্ষকতা এবং গবেষণা ছাড়া আর কোন পেশা বেছে নেওয়ার কোন সুযোগ আমার ছিল না। আমার সৌভাগ্য, আমি তাই করছি যা আমি করতে চেয়েছি। শিক্ষকতা অত্যন্ত উপভোগ করি। ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞানে উৎসাহী হয়ে উঠছে এটা দেখা খুব আনন্দের। গবেষণার ফলাফল যখন প্রকাশিত হয় তখনও খুব ভালো লাগে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ গবেষণা বরাদ্দের জোগাড় হয় কি করে?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ– দেশে আমি যে ধরণের কাজ করি তা অনেকটা তত্ত্বীয়। ভালো কনফিগারেশনের কম্পিউটার এবং বিভিন্ন জার্নালের অ্যাক্সেস ছাড়া তেমন কিছু দরকার পড়ে না। কাজেই আমার গবেষণা খুব একটা বরাদ্দ নির্ভর নয়। সম্প্রতি নতুন কম্পিউটার ক্রয়ের জন্য কিছু বরাদ্দ পেয়েছি। এর আগে দেশে রিসার্চ ফান্ডিং-এর জন্য আবেদনের প্রয়োজন পড়েনি। আমাদের দেশে গবেষণায় বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল এবং বেশ লাল ফিতের দাপট আছে। অর্থ ছাড় এবং হিসেব দাখিলের প্রক্রিয়ার ভেতরেও ত্রুটি আছে। তাই ছোট ছোট কিছু খরচ অনেক সময় নিজের পকেট থেকে হয়ে যায়। এ সবের জন্য বরাদ্দ আবেদনের ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করে না। দেশের বাইরে যখন এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেছি তখন গবেষণা বরাদ্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুক্তরাজ্য এবং নিউজিল্যান্ডে দুটি প্রজেক্টের সাথে যুক্ত ছিলাম যাদের সম্মিলিত বরাদ্দ প্রায় আধা মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং ছিল। বাংলাদেশে গবেষণা অত্যন্ত অবহেলিত।
প্রায় সবকিছুর মত রাষ্ট্রেরও গুণগত মানের প্রশ্ন আছে। একটি সুন্দর রাষ্ট্র গবেষণা তথা জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে মূল্যবান বলে মনে করে। মেধা মননে পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রে এসবের মুল্য কম। এখানে জ্ঞানী এবং আলোকিত নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম। এই জায়গায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ গবেষণা বরাদ্দের বেশীর ভাগটা কোথা থেকে আসে? দেশ না বিদেশ থেকে?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ– এই প্রশ্নের জবাব বোধহয় একটু আগেই দেওয়া হয়েছে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ বাংলাদেশে গবেষণায় একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। বৈশ্বিক অবস্থার বিচারে এই ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ– খুব দূরে তাকানোর দরকার নেই। বাংলাদেশের তুলনায় উচ্চতর গবেষণায় ভারত, এমন কি পাকিস্তানেও বরাদ্দের পরিমাণ অনেক বেশী। উচ্চতর গবেষণার জন্য যে ধরণের অবকাঠামোর প্রয়োজন সেই বিচারেও আমাদের দেশ ভারত, পাকিস্তানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এর কারণ বহুবিধ। প্রথম কথা হচ্ছে, এই রাষ্ট্র ও সমাজ জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান সৃষ্টিকে কতটুকু মূল্য দেয়? এই দেশে লেখাপড়া সার্টিফিকেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। যারা গবেষণা করেছেন, গবেষণা ভালবাসেন, জ্ঞানচর্চায় আনন্দ পান, তাঁরা কি আমাদের দেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন? নাকি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার সমর্থকদের জায়গা দেওয়া হয়? বাস্তবতা কি বলে? যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁদের যদি শিক্ষা এবং গবেষণার প্রতি অনুরাগ না থাকে এবং তাঁদের পছন্দের মানুষেরাই যদি শিক্ষা এবং গবেষণায় বরাদ্দ নির্ধারণ করেন তাহলে এখন যা হচ্ছে তাই হতে থাকবে। এই ব্যাপারে দেশের অ্যাকাডেমিক জগতে সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। সেই সচেতনতা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আমরা সবাই বরাদ্দ সমস্যার কথা বলছি, কিন্তু সমস্যার মূলে হাত দিতে চাইছি না। ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষেরা দায়িত্ব পাচ্ছেন না।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনার গবেষণার ক্ষেত্রগুলো কি কি? দেশে গবেষণার জন্য কি ধরণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছেন?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ প্রথম এবং প্রধান গবেষণার বিষয় হচ্ছে হোল ডোপড্ (hole doped) কিউপ্রেট সিস্টেমের অতিপরিবাহিতা। এই কিউপ্রেটগুলো আবিষ্কৃত হয় সেই ১৯৮৬ সালে। আমার গবেষণার শুরু ১৯৯৬ থেকে। কিউপ্রেটের চার্জ ট্রান্সপোর্ট এবং ম্যাগনেটিক প্রোপার্টির উপর সুডোগ্যাপের ভূমিকা নিয়ে এখন পর্যন্ত কাজ করছি। এই বিষয়ে অনেকগুলো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও কিউপ্রেটের ক্রিটিক্যাল কারেন্ট এবং ভোরটেক্স ডাইনামিকস নিয়েও কিছু কাজ করেছি এবং এখনো করছি। গত পাঁচ বছর ধরে ম্যাক্স ন্যানোলেমিনেটস, সুপারহার্ড ম্যাটেরিয়ালস এবং নতুন আবিষ্কৃত কিছু নিম্ন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহীর উপর তত্ত্বীয় ডজন খানেক কাজ হয়েছে। বর্তমানে সর্বোচ্চ ক্রান্তি তাপমাত্রায় (২০৩ ডিগ্রী কেলভিন) অতিপরিবাহী হচ্ছে সালফার হাইড্রাইড। এই যৌগটি নিয়ে বর্তমানে আমাদের ল্যাবে তত্ত্বীয় কাজ হচ্ছে। এক্সপেরিমেন্টাল কাজের জন্য দেশে কোন সুযোগ নেই। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হলে কিছু এক্সপেরমেন্ট করেছি। যেহেতু রিসার্চ কোলাবরেশন আছে, অনেক সময় কেম্ব্রিজে করা এক্সপেরিমেন্টাল ডাটা ব্যবহার করতে পারি। তত্ত্বীয় কাজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়। প্রফেসর এ কে এম আজহারুল ইসলাম অনেক পরিশ্রম করে এখানে একটি থিওরেটিক্যাল কন্ডেন্সড ম্যাটার ল্যাব গড়ে তুলেছেন। সেখানে কাজ হয়। বর্তমানে আমরা ল্যাবটিকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করছি। বিভিন্ন বর্ষের এমএসসি, এমফিল এবং পিএইচডি ছাত্রছাত্রীরাসহ বর্তমানে প্রায় দশ-বারো জন এই ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছে। থিওরেটিক্যাল কন্ডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সে এই ল্যাবটি বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রডাক্টিভ ল্যাব, তা বোধহয় নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আমরা এতটুকু তৃপ্ত নই, কারণ বিশ্বমানের বিচারে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনার তত্ত্বাবধানে কতজন গবেষণা করেছে? গবেষণা ছাত্রদের মধ্যে আপনি কোন কোন গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে চান?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ বর্তমানে কর্মরত সহ, এখন পর্যন্ত এমএসসি, এমফিল এবং পিএইচডি পর্যায়ে সর্বমোট ১৭ জন ছাত্রছাত্রী। গবেষণা প্রকল্পে ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতে পছন্দ করি। আমি চাই তারা প্রতিটি পর্যায়ে কিছুটা হলেও নিজে চিন্তা করা শিখুক। গবেষণা এক ধরণের প্রশিক্ষণও বটে। কি করে প্রজেক্ট বেছে নিতে হয়, প্রতিদিনের গবেষণা কাজের রিপোর্ট রাখা, সমস্যার সমাধানের জন্য লিটেরেচার সার্চ ইত্যাদি শেখানোর চেষ্টা করি। রিসার্চ স্টুডেন্টদের অবশ্যই নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস থাকতে হবে। পরিশ্রম বিমুখ হওয়া চলবে না।
আমাদের দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি মস্ত বড় সমস্যা আছে। যে ব্যাপারে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। আমি এটাকে এথিক্সের সঙ্কট বলে মনে করি। একটি কথা সকলের মনে রাখা উচিৎ, বিজ্ঞানের যে অতুলনীয় সাফল্য, এর পেছনে কারণ দুটি। এক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (scientific methodology) এবং বিজ্ঞান চর্চার এথিক্স। এই এথিক্সের জায়গাটাতে আমাদের দেশে ভীষণ ক্ষয় হয়েছে। গবেষণায় কোন অবদান না রেখে অন্য প্রভাব খাটিয়ে কেউ কেউ অথর লিস্টে ঢুকে পড়ছে। সাইটেশনের কিছু নিয়মকানুন আছে। অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। অন্যের কাজের কিছু অংশ হুবুহু তুলে দেওয়া হচ্ছে (plagiarism), যেখানে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের (acknowledgement) প্রয়োজন সেখানে তা করা হচ্ছে না, ইত্যাদি। এই সব প্রশ্নবিদ্ধ চর্চা বন্ধ না হলে মানসম্মত গবেষণা কখনো সম্ভব হবে না। ছাত্রছাত্রীদের এই সব বিষয়ে সচেতন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। প্রত্যাশা হচ্ছে আমার তত্ত্বাবধানে যারা কাজ করবে তারা এথিক্সের ব্যাপারে যত্নবান হবে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ যদি সরকার বাংলদেশে বিজ্ঞান গবেষণার উৎকর্ষতার জন্য আপনার কাছে পরামর্শ চায় তাহলে আপনার প্রধান তিনটি পরামর্শ কি হবে?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ মনে হয় না সরকার পরামর্শ চাইবে। সরকার তা যেই হোক না কেন, তার পরামর্শ চাওয়ার ধরাবাঁধা লোক আছে। যাই হোক, প্রথম পরামর্শ হবে একাডেমিক বিষয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে গবেষকদের যোগ্যতার মূল্যায়ন করুন। দ্বিতীয় পরামর্শ হবে উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। কোন ধরণের দলবাজি বরদাস্ত করা যাবে না। তৃতীয় পরামর্শটি হচ্ছে – শিক্ষা এবং গবেষণায় বর্তমানে যা বরাদ্দ তা অন্তত শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাড়াতে হবে এবং তা বণ্টনের জন্য স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ তরুণ ছাত্র যারা গবেষণায় আসতে চায়, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে, তাদের জন্য আপানার পরামর্শ কি?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ প্রথম এবং প্রধান ব্যাপাটি হচ্ছে নিজ বিষয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ থাকতে হবে। বর্তমানে যে গৎবাঁধা প্রশ্ন পত্রে পরীক্ষা হচ্ছে এবং তার জন্য রেজাল্ট নির্ভর যে প্রস্তুতি অনেক ছাত্র নিচ্ছে তা ভবিষ্যতে গবেষণায় খুব সহায়ক হয় না। উচ্চ স্তরের বিষয় জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। গবেষণার জন্য দরকার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা। ভালো একটি প্রজেক্ট খুঁজে নিতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। ভালো গবেষণা প্রকল্প মানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং গবেষণা প্রকল্প। প্রকল্পকে সাফল্যের সাথে শেষ করার পথ কঠিন। বাঁধা বিপত্তি ছাড়া যে গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে যায় তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই খুব আকর্ষণীয় বা অর্থবোধক প্রকল্প নয়। বাঁধা বিপত্তি আসবে এবং তা অতিক্রম করার ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। মানুষ ঠেকে শেখে, এই কথা গবেষণার ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য।
যারা পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করতে চায় তাদের মনে রাখা উচিৎ, প্রকৃতিগত ভাবেই পদার্থবিজ্ঞান একটি কঠিন বিষয়। এই কথা খুব বড় পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্যও খাটে। তবে যত কঠিন চ্যালেঞ্জ, তা অতিক্রম করার আনন্দও তত বড়। এই বড় আনন্দের যারা স্বাদ নিতে চায় তারা পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণায় ভালো করবে। পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা আমার কাছে রোলারকোস্টার রাইডের মত মনে হয়। উৎকণ্ঠা আছে, আনন্দ আছে, একটি মুহূর্তও বোরিং নয়।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ বাংলাদেশে বিজ্ঞানীদের যে সব পেশাগত সংগঠন আছে সেগুলো কি তাদের ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করছে? এই সংগঠনগুলোর ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কি?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই হয়ত সোজা সাপটা কথা বলতে পছন্দ করি। অন্যান্য প্রশ্নের মত এই প্রশ্নেরও সোজা জবাব দিতে চাই। সমস্ত সংগঠনের খবর আমার জানা নেই। যেগুলো সম্পর্কে একটু জানি, তার একটিও তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা ঠিকমত পালন করছে না। ঘুরে ফিরে প্রতিটির কর্মকাণ্ডই ঢাকা কেন্দ্রিক। এই প্রবণতা স্বাস্থ্যকর নয়। তারপর যদি পরিচালনা পর্ষদের দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন বহু বছর ধরে ঘুরে ফিরে একই মুখ সেখানে। অনেকেই কার্যকর গবেষক হিসেবে তাঁদের সময় অনেক আগেই শেষ করেছেন। পদ পদবী অনেকটা সিন্ডিকেট করেই যেন ধরে রাখা হয়েছে। যেখানে এই সংগঠনগুলোর অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিৎ প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গবেষকদের সামনে নিয়ে আসা, সেখানে তা তেমন করা হচ্ছে না। কনফারেন্সগুলোতে মানের প্রশ্নে আপোষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইন্টারডিসিপ্লিনারি গবেষণার অবস্থা বেশ করূণ। অথচ এর প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু দায়সারা কিছু কাজ ছাড়া বিজ্ঞান একডেমীর তেমন কোন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আমরা উল্লেখ করিনি, এমন কোন পয়েন্টে পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ গবেষণায় অগ্রগামী দেশগুলোতে দীর্ঘদিনের গবেষণা ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্য আমাদের এখানে তৈরি হয় নি। হয়ত ভবিষ্যতে হবে। তবে এই ঐতিহ্য গড়ে তুলতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাক্সবন্দী করে ফেলেছে। এর ফলে এক ধরণের গোষ্ঠীতন্ত্র অ্যাকাডেমিক জগতেও বাসা বেঁধেছে। চিন্তার পরিধিকে বিস্তৃত না করতে পারলে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অনেক সময় লাগবে।
সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশঃ আপনার সময়ের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ডঃ সালেহ হাসান নকীবঃ কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সায়েন্টিফিক বাংলাদেশকেও অনেক ধন্যবাদ।