Scientific Bangladesh

সবুজ ও অর্থনীতি বান্ধব নগর পরিকল্পনা এনে দিতে পারে কংক্রিটের ঢাকা শহরে সবুজের সমারোহ

ফয়সাল কবির শুভ

পটভূমিঃ

গত চার দশকে ঢাকা শহর যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতা পরবর্তীতে নতুন দেশের রাজনীতি হিসেবে আবির্ভুত হওয়া, দেশি-বিদেশী বিনিয়োগ এবং সেই সাথে নতুন কর্মসংস্থান এর কারনে প্রচুর পরিমানে গ্রাম থেকে মানুষের শহরে আগমন, অপরিকল্পিতভাবে শহরের বিভিন্ন ভূমি ব্যবহার সব একত্রিত হয়ে এবং অসমভাবে ঢাকা শহরের কলেবর বৃদ্ধির পিছনে কাজ করেছে। এই বৃদ্ধির সাথে অব্যবহিত ভাবেই কমেছে জলজ এবং সবুজ ভূমি। জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি বা ইউ এন ই পি থেকে বলা হয়েছে যে ‘টেকসই উন্নয়নের’ জন্যে একটি শহরের মোট ২৫% উন্মুক্ত ভূমি থাকা প্রয়োজন। সাধারনত এই উন্মুক্ত ভুমি বলতে সবুজ এবং জলজ ভূমির একটা সহাবস্থানকে বোঝায়। কিন্তু ব্যোমকেশ এবং অন্যান্যদের (২০১২) মতে, আমাদের ঢাকা শহরে আছে এই উন্মুক্ত ভূমি আছে মাত্র ১৪% এর মতো। দেওয়ান এবং অন্যান্যদের (২০১০)একটা গবেষনা থেকে দেখা যায় ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ঢাকা শহরের কংক্রিট আচ্ছাদৃত এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫,৫০০ হেক্টর থেকে ২০,৫৪৯ হেক্টর। সেইসাথে একই সময়কালে কৃষিযোগ্য জমির পরিমান কমেছে ১২,০৪০ হেক্টর থেকে ৬,২৩৬ হেক্টর এ। একইসাথে জলজভূমি এবং সবুজ আচ্ছাদৃত এলাকা কমেছে যথাক্রমে ৬,০২৭ এবং ২,৮১২ হেক্টর। নিচের কিছু পরিসংখ্যান থেকে এই অবস্থার বাস্তবতা আরো ভালো বোঝা যাবে।

 

-> বুয়েটের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষনায় দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটান এলাকায় স্বল্পস্থায়ী জলজভূমির পরিমান ১৯৮৯ সালে ছিলো ৪০,৭৬৫ হেক্টর যা ২০০৫ এ কমে আসে ২৪,২০৮ হেক্টরে।

 

->ইসলাম এবং অন্যান্যদের ২০১১ সালের একটি সমীক্ষামূলক গবেষনা থেকে দেখা যায় ১৯৬০ সালে ঢাকা শহরে জলজভূমি এবং নিম্নভূমি ছিলো যথাক্রমে ২,৯৫২ এবং ১৩,৫২৭ হেক্টর যা কমে ২০০৮ সালে কমে এসেছে ১৯৯০ এবং ৬৪১৪ হেক্টরে।

 

->সবুজ ধ্বংসের ব্যাপারে রহমান এবং অন্যান্যরা (২০১১) তাদের গবেষনায় দেখতে পেয়েছেন যে ১৯৮৯ সাল থেকে বৃহত্তর ঢাকাতে ক্রমবর্ধমানভাবে সবুজ এলাকা ধ্বংস হয়ে চলেছে। ১৯৮৯, ২০০২ এবং ২০১০ সালে এই সবুজ এলাকা ধ্বংসের পরিমান ছিলো যথাক্রমে ৭৭৪৩ হেঃ, ২৮৭১ হেঃ এবং ১৯৮ হেক্টর।

 

->ঢাকা মূল শহরে (সিটি কর্পোরেশন অধিভূক্ত) এই ধ্বংসের পরিমান আরো নাজুক। ব্যোমকেশ এবং অন্যান্যদের (২০১২) এর গবেষনায় পাওয়া যায় যে ১৯৮৮, ১৯৯৯ এবং ২০০৫ সালে সবুজ এলাকা ধ্বংসের হার ছিলো যথাক্রমে ২০.৪%, ১২.৫% এবং ২২.৮%।

 

 ধূসরায়নে ঢাকা এবং বাসযোগ্যতাঃ

স্যাটেলাইট ইমেজের উপর নির্ভর করা এই গবেষনালব্ধ ফলাফলগুলোতে সংখ্যার কিছু তারতম্য থাকলেও, একটা জিনিস স্পষ্ট যে ঢাকা শহর এবং তার আশেপাশে জলজ,কৃষি এবং সর্বোপরি সবুজ এর আচ্ছাদন বিগত সব বছরে ক্রমশ কমেছেই বৈ বাড়েনি। এবং অবশ্যম্ভাবি ভাবেই এই ধ্বংস হয়েছে সেই স্থানগুলো কংক্রিটের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে অর্থ্যাত মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন ইমারত বানানোর মাধ্যমে। কংক্রিটের এই আচ্ছাদনকেই ‘ধূসরায়ন’ বলা যায়। বেসরকারী ভূমি উন্নয়ন কোম্পানী এবং শিল্পপতিরা যে এই ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে সেটাও নির্ধিধায় বলা যায়। আবার ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন চাপও ফেলে দেবার মত ইস্যু না। তাই মোটামুটি নগর পরিকল্পনার দূর্বলতা বা অদূরদর্শিতার কারনে যে তাদের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরে কোন ‘জোনিং’ রেগুলেশন সঠিকভাবে চালু হয়নি আর যেকারনে যে যেভাবে পেরেছে ভূমি ব্যবহার করেছে এবং এভাবেই ঢাকা শহরের সবুজ এবং নীলগুলো ধ্বংস হয়েছে। এরপরও, একটা ভালো দিক যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছে এবং তা গেজেটিকরন হয়েছে, যদিও সেই মাস্টারপ্ল্যান বা ড্যাপের অনেক প্রস্তাব নিয়েই বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে মত-পার্থক্য আছে। ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টের’ সমাধানে শহরের অর্থনৈতিক প্রভাবশালী গ্রুপেরা অগ্রগনিত হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু, এতোকিছুর পরও ঢাকার ‘বাসযোগ্যতা’ পুনরুদ্ধারের ব্যাপারটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। বিশেষ করে, শহরের নীতি নির্ধারকদের জন্যে মূল শহর কনক্রিটের আচ্ছাদন অত্যন্ত ঘন, সেখানে ‘বাসযোগ্যতা’ ধরে রাখা অবশ্যই একটা বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। কঠিন এবং নাজুক এই বাস্তবতায়, সম্পূর্নভাবে তাই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা নিছকই কল্পনাপ্রসুত ব্যাপার কিন্তু যে উপাদানগুলার কারনে শহরের ‘বাসযোগ্যতা’ হারানোর কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার পূনর্জাগরন আনতে উদ্যমী তো হওয়াই যায়। কংক্রিটের আচ্ছাদনের কারনে যে সবুজ এবং জলজ ভূমি ধ্বংস হয়েছে তা কিভাবে নতুনভাবে ঢাকা শহরে আনা যায় সেইদিকেই শহর কর্তৃপক্ষ এর নজর দেয়া উচিত। এই লেখাটায় কংক্রিটের শহরে কিভাবে ‘সবুজের’ সরবরাহ বাড়ানো যায় সেই ব্যাপারেই আলোচনা করা হয়েছে।

একনজরে ঢাকা শহরের ধূসরায়নের দিকে তাকানো যাক। ড্যাপের জি আই এস তথ্য অনুসারে নিচের ম্যাপটি বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন ভূমি ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেছেঃ

ড্যাপ তথ্য অনুসারে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন প্রায় ১০৬ বর্গ কিলোমিটার (১০৬,০০০ হেক্টর) যা ১৩ টি ভূমি ব্যাবহারের ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে এখানে (ক্যান্টনমেন্ট সহ কিছু এলাকার ভূমি ব্যবহারের তথ্য এখানে নাই)। উপরের ডানপার্শের চিত্র থেকে সুষ্পষ্টভাবে দেখা যায় যে ৮৮% এলাকা কংক্রিট স্বর্বস্ব ভূমির ব্যবহার। এই কংক্রিটের ব্যবহার বহুলাংশেই আগের বৃক্ষ বা গুল্ম বা ঘাস আচ্ছন্ন ভূমিকে প্রতিস্থাপিত করেছে। এই অবস্থায় শহর কর্তৃপক্ষ এই ‘সবুজের’ সরবরাহের ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে যে ঢাকা শহর তার ‘বাসযোগ্যতা’ হারিয়ে ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। একইসাথে যদি ঢাকা শহরের অধিবাসীরা এই ব্যাপারে এগিয়ে না আসে তাহলে ‘নাগরিক বিপর্যয়ের’ জন্যে সবাই সমানভাবে দায়ী থাকবে।

 

মূল শহরে সবুজের পূনর্গামন করানোর জন্যে আমি এখানে একটি ‘নগর পরিকল্পনার’ যন্ত্র বা নীতির কথা আলোচনা করবো। এই যন্ত্রটি কংক্রিট স্বর্বোস্ব ভূমিতে সবুজের অনুপাত ঠিক করে দিবে এবং তা ঐ ভূমির মালিককে অবশ্যই পূরন করতে হবে। এই ধারনাটি ডঃ অং বুন লে নামক একজন স্থপতি’র প্রস্তাবিত ‘Green plot ratio’ নামক তত্ত্ব থেকে নেয়া হয়েছে । ডঃ বুন লে বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ন এ শিক্ষকতা করছেন কিন্তু এই তত্ত্বটি তিনি গবেষনার মাধ্যমে প্রস্তাব করেছেন যখন তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরে অধ্যাপনা করতেন। নগর পরিকল্পনায় তার এই তত্ত্ব, ঢাকা শহরের জন্যে বাঞ্ছনীয় নীতি হিসেবে যদি শহর কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে তা একাধারে শহরবাসি, বেসরকারী ভূমি উন্নয়নকারী, শহর ব্যবস্থাপক সহ সব গ্রুপের জন্যেই কল্যান বয়ে আনবে। অর্থ্যাত এর ফলে পরিবেশগত উন্নয়নের সাথে সাথে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিকেও যথেষ্ঠ উন্নতির সম্ভাবনা আছে। এই লেখায় সেইসব দিক নিয়েই তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে জেনে নেই ‘Green plot ratio’ নামক তত্ত্বটি আসলে কি?

 

গ্রীন প্লট রেশিও’ তত্ত্ব

এই তত্ত্ব মূলত একটি জমির প্লটে বিল্ডিং এর ঘনত্ব অনুযায়ী কতখানি এলাকা সবুজ এলাকা রাখা উচিত। এই সবুজ এলাকা ঠিক করার জন্যে ডঃ বুন লে উদ্ভিদতত্ত্ব থেকে কিছু তাত্ত্বিক ধারনা নিয়ে এসেছেন। ‘লিফ এরিয়া ইনডেক্স’ নামের একটি তত্ত্ব যা একটি উদ্ভিদের পত্রের ঘনত্বের সাথে যতখানি ভূমি ঐ উদ্ভিদ দখল করে আছে তার একটি অনুপাত বোঝায়। এই ‘পত্র ঘনত্ব’ মূলত ঐ উদ্ভিদের ‘সালোকসংস্লেষন’ প্রক্রিয়ার মাত্রা ঠিক করে অর্থ্যাত কতখানি কার্বন-ডাই-অক্সাইড সেই উদ্ভিদ গ্রহন করছে। উদ্ভিদের ধরন অনুযায়ী এই ‘লিফ এরিয়া ইনডেক্স’ এর মান বিভিন্ন হয়। যেমনঃ ঘাসের জন্যে এর মান ১; গুল্ম প্রকৃতির গাছের জন্যে ৩; এবং বৃক্ষের জন্যে ৬ থেকে ১০ হতে পারে। বৃক্ষের জন্যে এই ভিন্ন মান ধরার কারন হলো বৃক্ষের ঘনত্ব কোন রোপন করা কৃত্তিম বনায়ন থেকে প্রাকৃতিক বনের জন্যে ভিন্ন হয়। সুতরাং, একটি ভূমিএর গ্রীন প্লট রেশিও উদ্ভিদপত্রের আচ্ছাদনভেদে ১:১; ১:৩ কিম্বা ১:৬ থেকে ১:১০ হতে পারে। এই ধারনা থেকে নগর পরিকল্পনাবিদ কিম্বা স্থপতিগন একটি নতুন এলাকা উন্নয়নের জন্যে বা নতুন ইমারতের কারনে কতখানি সবুজ ধ্বংস হয়েছে এবং তা কিভাবে নতুন করে সরবরাহ করা যাবে তার একটি রুপকল্প করে ফেলতে পারবেন। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়ঃ ৫০০০ বর্গমিটার একটি নতুন জমি উন্নয়নের জন্যে ৩০০ বর্গমিটার ঘাসাচ্ছিত, ২০০ বর্গমিটার গুল্ম ধরনের উদ্ভিদ এবং ৪০০ বর্গমিটার বৃক্ষ ধ্বংস করতে হয়েছে। এখন ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে ঐ ভূমিতে উত্তোলিত নতুন কংক্রিটের কাঠামোর মধ্যে এই সবুজকে পূনর্জাগরন করা সম্ভব। হয়তো যে বৃক্ষের ধ্বংস হয়েছে তার পুরোটাই সরবরাহ করা যাবেনা কিন্তু তার পরিবর্তে গুল্ম বা লতা ধরনের উদ্ভিদ ঐ ভুমি এলাকার বিভিন্ন ইমারত ও ফাকা জায়গায় লাগিয়ে হারানো ‘পত্র ঘনত্ব’ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সূতরাং, এই তত্ত্ব যদি শহর উন্নয়নের নীতি আকারে ঢাকা শহরে চালু করা যায়, শহরের চেহারা হবে অনেকটা এইরকমঃ

 

কেন ‘পত্র বা সবুজ ঘনত্ব’ দরকার?

সবুজের আচ্ছাদন বা ‘পত্র-ঘনত্ব’ কেন দরকার সে বিষয়ে আসলে নতুন করে বলার কিছু নাই। গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সবুজের ব্যবহার সবচেয়ে পরিচিত কারন হলেও, শহরের আভ্যন্তরিন উষ্ণতার অন্যতম কারন হলো কংক্রিটের আচ্ছাদন এবং সেখানে সবুজের ঘনত্ব বাড়ানো খুবই দরকার। এছাড়াও সবুজ মানসিক সুস্থতা এবং শহরের নান্দনিকতা বাড়ায়। এখানে কিছু গবেষনালব্ধ তথ্য দেয়া হলোঃ

->ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরে চালিত এক গবেষনার মাধ্যমে হাইয়েন এবং য়ুসুফ (২০০৮) দেখিয়েছেন যে পরিবেশ ঠান্ডা (এয়ার কন্ডিশনিং) করার জন্যে যে পরিমান শক্তির প্রয়োজন হয় তার ব্যবহার গ্রীন প্লট রেশিও ১:১ এর মাধ্যমে ৩.২৮% থেকে ৯.০৮% পর্যন্ত কমানো যায়; ১:৩ এর মাধ্যমে কমানো যায় ৬.৭৩% থেকে ১৮.৮৫% এবং ১:৬ এর মাধ্যমে কমানো যায় ৭.১৬% থেকে ২০.০১%

-> হাইয়েন (২০০৭) এর আরেকটা গবেষনায় জানা যায় যে, ইমারতের ছাদে সবুজায়নের মাধ্যমে কংক্রিট আচ্ছাদনের তাপমাত্রা প্রায় ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পরিবেশের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো যায়।

-> জেলনার এবং অন্যান্যরা (২০০৮) বলেছেন যে এক হেক্টর বনভূমি বছরে ১,৮০০,০০০ গ্রাম কার্বন গ্রহন করে। সুতরাং এ থেকে কতখানি কার্বন ডাই অক্সাইড বৃক্ষ শোষন করে ফেলে তা সহজেই বোঝা যায়।

 

সবুজ শিল্পের অর্থনৈতিক দিক

সবুজায়নের কথা বললেই এর পরিবেশত দিকটাই সবার কাছে মূখ্য মনে হয় আর এই কারনে একটি শহরের অর্থনীতিতে যারা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে সেই ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের কাছে ‘সবুজায়ন’ এর গুরুত্ব তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু শহরে ‘সবুজায়ন’ যে আর্থ-সামাজিক দিকেও একটা গতিশীল ভূমিকা রাখতে পারে তা আমরা হয়তো অনেকেই চিন্তা করিনি। বিভিন্ন গবেষনালব্ধ ফলাফল থেকে শহরে সবুজায়নের অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কে জানা যায়, তবে আলোচনা আর দীর্ঘ করার অভিপ্রায় না থাকায় সে সম্পর্কে গভীরে আর গেলাম না। শহরের জন্যে বাঞ্ছনীয় নীতি হিসেবে যদি শহর কর্তৃপক্ষ (উদাহরনস্বরুপ, রাজউক) যদি বিভিন্ন ধরনের স্থাপনার জন্যে ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ এর মান বাধ্যতামূলক করে দেয় তাহলে এ দেশে ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন্ডাস্ট্রি’ নামক এক ধরনের শিল্পের বিকাশ ঘটবে। সেই সাথে এই শিল্প যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে তেমনি মূদ্রাবাজারেও টাকার প্রবাহ বাড়াবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অতি ঘনত্বের শহরগুলোতে এই শিল্প একটি বিকাশময় অর্থনৈতিক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। কিভাবে ল্যান্ডস্কেপ শিল্প শহরের কংক্রিটের স্থাপনায় নান্দনিকতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভাবেও তা নিচের ছবি থেকে বোঝা যায়।

 

এই ছবিটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের একটি ছাত্রাবাসের কংক্রিট আচ্ছাদৃত পরিবেশে ল্যান্ডস্কেপ শিল্পের মাধ্যমে কিভাবে সবুজায়ন করা হয়েছে তা দেখানো হয়েছে। এই পরিকল্পনাটি সিঙ্গাপুর সরকারের টেকসই উন্নয়নের ব্যাপারে জাতীয় লক্ষ্যের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগীদের যৌথ ব্যবস্থায় বাস্তবায়িত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সাথে যেমন জড়িত ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানিং/ডিজাইন পেশা, তেমনি জড়িত এই ধরনের সবুজায়নের জন্যে বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ প্রক্রিয়াকরন বা নার্সারী এর ব্যবসা, কংক্রিটের পৃষ্ঠে এই ধরনের সবুজায়ন বাস্তবায়িত করার জন্যে বিশেষ বস্তু এবং তার শিল্প, এবং সবুজায়নের বিভিন্ন ধাপের জন্যে এবং একই সাথে রক্ষনা-বেক্ষনের জন্যে দরকার বিশেষ দক্ষ জনবল। মেগাসিটি ঢাকা শহরে এইরকম ‘সবুজায়ন’ সফল করতে নগর কর্তৃপক্ষ থেকে সব ধরনের স্থাপনার জন্যে বাধ্যতামূলক ‘সবুজ আইন’ করার মাধ্যমে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন এবং পরিকল্পনাতেও সৃষ্ঠিশীলতা এবং উতকর্ষতার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হবে। কংক্রিট পৃষ্ঠে সবুজায়নের জন্যে ‘বিশেষ পদ্ধতিতে’ বাগান করার দরকার পড়ে, নিচের ছবির মাধ্যমে তার একটি উদাহরন দেওয়া হলোঃ

সূতরাং, দেখা যাচ্ছে এই ধরনের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্যে কংক্রিটের উপর পর্যায়ক্রমে পানিরোধক মেমব্রেন, পানি নিষ্কাশনের স্তর, জিও-টেক্সটাইল ফাইবার এর আঁশ এবং মাটিবিহীন গাছ লাগানোর মাধ্যম সমৃদ্ধ একটি বিশেষ সিস্টেম লাগে। এবং এই সিস্টেমের সাথে সংশ্লিষ্ঠ বস্তুগুলাও একেকটি বানিজ্যিক শিল্প হিসেবে পরিগনিত হতে পারে।

 

‘গ্রীন বিজনেস’ এবং অংশিদারী দায়িত্ব

রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলো হয়তো এই ‘সবুজায়ন আইন’ তাদের জন্যে অর্থনৈতিকভাবে ‘বোঝা’ হিসেবে মনে করতে পারে কিন্তু নগর প্রশাসন থেকে এই আইন সঠিকভাবে মেনে চলার জন্যে ঐসব রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলোর জন্যে বিশেষ ‘উতসাহমূলক’ প্রনোদনা দিতে পারে। অন্যদিকে, রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলো এই ‘সবুজায়ন’ রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বভার তাদের ভোক্তা গ্রুপের উপর দিতে পারে। ভোক্তা-গ্রুপ আবার সেই রক্ষনাবেক্ষনের জন্যে প্রয়োজনীয় জনবল ঐ কোম্পানীগুলা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। শহরের অধিবাসীদের ‘সবুজের’ ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে, তারা সাধারনত ঐসব রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলার দিকেই যাবে যারা যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে ‘সবুজ ছাড়পত্র’ পেয়েছে। এমনিতেও সাড়া পৃথিবীতে এখন ‘গ্রীন লেবেলড’ পন্যের দিকে ভোক্তাদের একধরনের আকর্ষন ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এমনকি এবারের পরিবেশ দিবসের স্লোগানও ছিলো ‘গ্রীন বিজনেস’ নিয়ে। সুতরাং এটাই উপযুক্ত সময়, এই ‘গ্রীন বিজনেস’ কে নগর উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আনার।

 

অন্যদিকে, ঢাকা শহরকে যদি এইভাবে ধীরে ধীরে সবুজ দিয়ে আচ্ছাদৃত করে ফেলা যায়, তা বিশ্ব দরবারে ঢাকার অন্যরকম একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ঢাকার নগর প্রশাসককে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় পরিবেশ ও নগর সম্পর্কিত ফোরামে ডাকা হবে এবং তা অবশ্যই সারা দেশের জন্যে সম্মানজনক হবে। সুতরাং, ঢাকা শহরের ব্যাপক ভিত্তিক সবুজায়নের জন্যে দরকার নগর প্রশাসন, বেসরকারী ভূমি উন্নয়নের কারিগর (রিয়েল এস্টেট কোম্পানী, শিল্পপতি সহ অনেকে) এবং সকল প্রকার নগর অধিবাসীদের মধ্যে একটি অংশিদারী দায়িত্ববোধ। এর অর্থনৈতিক সুবিধা সবার মধ্যে সমভাবেই বন্টিত হবে যেমনটা নিচের এই সারনী থেকে দেখা যায়ঃ

মূল প্রস্তাবনাঃ

ঢাকা শহরের জন্যে রাজউককে ‘সবুজায়নের’ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যদিও, ড্যাপ প্রনয়নের মাধ্যমে রাজউক দেরিতে হলেও অনেকটা প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে কিন্তু তারপরও ড্যাপের মূল প্রস্তাবনায় ‘সবুজায়নের’ মাধ্যমে কংক্রিটময় স্থানে সবুজ আচ্ছাদনের ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ঠ প্রস্তাবনা নাই। সবুজের মাধ্যমে যে শহরের পরিবেষ্ঠিত পরিবেশ এর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে কংক্রিটময় শহরে ‘বাসযোগ্যতা’ আনা সম্ভব সেটা বুঝে বাধ্যতামূলক ‘সবুজ নীতি’ গ্রহণ করা উচিত। এইজন্যে শহরের আভ্যন্তরীন বিভিন্ন ভূমির ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ র উপর নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট পরিমান ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ এর মান ঠিক করে দিতে হবে। যদিও, ঢাকা শহরে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অনেক ইমারত গড়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক কারনে এই ইমারতগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাজঊক বেশিরভাগ সময় অপারঙ্গম। কিন্তু এই ইমারত বা ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ‘লঘু জরিমা্না’ স্বরুপ বাধ্যতামূলক ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ অর্জনমাত্রা ঠিক করে দিতে হবে এবং কমিউনিটি লেভেলেও সবুজায়নে তাদের অর্থনৈতিক এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়দায়িত্ব নিতে হবে। এইরকম সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা নিঃসন্দেহে ঢাকা শহরকে বিশ্বের দরবারে যেমন একটি ‘মডেল’ শহর হিসেবে উপস্থাপন করবে তেমনি ঢাকা শহরের আভ্যন্তরীন পরিবেশেরও যথেষ্ঠ উন্নতি লক্ষ্য করা যাবে। প্রসংগত, একটি কাল্পনিক অবস্থা অনুমান করা যাক এখানে। যদি ঢাকার সমগ্র কংক্রিটময় এলাকা বাধ্যতামূলক ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ এর মাধ্যমে বিভিন্ন মাত্রার সবুজ ঠিক করা হয় তাহলে সম্ভাব্য কার্বন ডাই অক্সাইড (যা শহরের ভিতরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারন) শোষিত হবার পরিমান নিম্নরুপ (জেলনার এবং অন্যান্যদের গবেষনা অনুসারে):

 

যদিও ঢাকা শহরের বর্তমান বাস্তবতায় ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ মান ১:৬ অর্জন করা প্রায় অসম্ভব এমনকি ১:৩ অর্জন করাই অনেক কঠিন হবে, তবে ১:১ থেকে ১:৩ এর মধ্যে এই মান ঢাকা শহরের বিদ্যমান কংক্রিট আচ্ছাদনের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব। সে মোতাবেক উপরের সারনীতে যে সম্ভাব্য CO2 শোষনের পরিমান এর কথা বলা হয়েছে তার প্রথম দুইটা সারির মাঝামাঝি মান অন্তত অর্জন করা সম্ভব। এবং এতে কিছুটা হলেও শহরের ‘মাইক্রো ক্লাইমেট’ বা একদম স্থানিক আবহাওয়া অনেকটা ঠান্ডা রাখা সম্ভব হবে। ‘আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ নামক তত্ত্বে শহরের স্থানিক বা আভ্যন্তরিন আবহাওয়া গরম হবার বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সাধারনত কংক্রিটের অতি ঘনত, কৃত্তিমভাবে পরিবেশ ঠান্ডা রাখার যন্ত্র বা এয়ারকন্ডিশনের ব্যাপক ব্যবহার, যানবাহন থেকে ধোয়া নির্গমন ইত্যাদি কারনে এই ‘আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ দেখা যায়। পাঠকদের সহজ প্রমানের জন্যে একটা বাস্তব উদাহরন দিবোঃ আপনারা যদি গ্রীষ্মের কড়া রোদের মধ্যে কখনো সি এন জি অটোরিক্সা বা অন্য যে কোন বাহনে যাতে কৃত্তিমভাবে ঠান্ডা করার উপায় নাই তাতে করে ফার্মগেট/ কাওরান বাজার এলাকা হতে ক্রমশ ‘জিয়া উদ্যানের’ পাশে দিয়ে কোন গন্তব্যে যান, আপনার গরম লাগার শারিরীক অনুভূতির একটা বিশাল পরিবর্তন বুঝতে পারবেন।

 

উপসংহার

উপরের আলোচনা থেকে এই বক্তব্য পরিষ্কার করার চেষ্ঠা করেছি যে- ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা টিকে রাখা এবং অনেকাংশে পুনর্জীবিত করার জন্যে বাধ্যতামূলক ‘সবুজ বিপ্লব’ ছাড়া অন্য উপায় নাই। এইক্ষেত্রে তা করতে হবে নগর পরিকল্পনার সঠিক নীতি এবং তার বাস্তবায়নের জন্যে। এই আলোচনায় ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ নামের সেইরকম একটা নীতির উপযোগিতা এবং উপকারিতার ব্যাপারেই আলোচনা করা হয়েছে। ঢাকা শহরে রাজঊক কিম্বা সিটি কর্পোরেশনের মতো নগর কর্তৃপক্ষকে এই ব্যাপারে অবশ্যই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু এই ‘গ্রীন প্লট রেশিও’ এর উপকারিতা শহরের সব শ্রেনীর মধ্যে বন্টিত হবে বলা আশা করা যায়।

 

ফয়সাল কবির শুভঃ বিদ্যায় নগর-পরিকল্পনাবিদ; গবেষনা করছেন শহর বৃদ্ধির পিছনে মিথোস্ক্রিয়ারত বিভিন্ন স্থান-কালের নিয়ামক ও তাদের চরিত্র নিয়ে; এবং কিভাবে আন্তঃমিথোস্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top