Scientific Bangladesh

Covid-19: বাংলাদেশে সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানির তৃতীয় পর্যায়ের ভ্যাকসিন ট্রায়াল

লন্ডন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্স জুলাই মাসের ২০ তারিখ বাংলাদেশে চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির করোনা ভ্যাকসিন ট্রায়াল সম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাদের সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC) ৪২০০ মানুষ অন্তর্ভুক্ত করে সিনোভ্যাক কোম্পানিকে তাদের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন দিয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেলে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ICDDR, B) এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করবে।

ব্রাজিলের ১২ টি হাসপাতালে সিনোভ্যাক কোম্পানির করোনা ভ্যাকসিনটির তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করার প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে ৫ টি জায়গায় ট্রায়াল শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর ভ্যাকসিন ট্রায়ালটি করা হবে বলেই ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখা প্রয়োজন।

সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটি কি?

সিনোভ্যাক ১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া করোনা রোগীর ফুসফুস থেকে করোনা ভাইরাস সংগ্রহ করে সবগুলোর জীনগত বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করেছে। এই ১১ জন রোগীর ৫ জন চীন, ৩ জন ইতালি, ১ জন সুইজারল্যান্ড, ১ জন ইংল্যান্ড ও ১ জন স্পেন থেকে নেয়া হয়েছে। জীনগত বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে চীন থেকে সংগ্রহকৃত একটি ভাইরাসকে কেমিক্যাল দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে মূল ভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে PiCoVacc. ইঁদুর ও বানরে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, এই একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাস দিয়ে তৈরী PiCoVacc ভ্যাকসিনটি বাকি ১০ টি ভাইরাস এর বিরুদ্ধেও এন্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম।

বানরে PiCoVacc ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা:

PiCoVacc ভ্যাকসিনটি বানরে ৩ টি ডোজ (১ ম দিন, ৭ ম দিন আর ১৪ তম দিন) প্রয়োগ করার ৩ সপ্তাহ পর যে পরিমাণ প্রতিরোধক এন্টিবডি (নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি) তৈরী হয় তা প্রাকৃতিকভাবে করোনা থেকে আরোগ্য লাভ করা রোগীর দেহে প্রাপ্ত এন্টিবডির চেয়ে অধিক। PiCoVacc ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করার ১ সপ্তাহ পর বানরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দেখা যায় প্রতিটি বানর কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ভাইরাস আক্রান্ত হওয়া থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। PiCoVacc ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ঐ গবেষণার ফলাফল গত মে মাসের ৬ তারিখ বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়।

মানুষে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা:

সিনোভ্যাক এখন পর্যন্ত ১৮-৫৯ বছরের ৭৪৩ জন সুস্থ মানুষের উপর তাদের ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করেছে। এদের মধ্যে ১৪৩ জন প্রথম ধাপ (ফেইজ-১) এবং ৬০০ জন দ্বিতীয় ধাপ (ফেইজ-২) এ অংশ নিয়েছে। ফেইজ-২ ট্রায়ালে প্রত্যেককে ২ টি করে ডোজ দেয়া হয়েছে। প্রথম ডোজ দেয়ার ১৪ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে। সিনোভ্যাক এর সংবাদ সম্মেলন অনুযায়ী দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার ১৪ দিনের মাথায় শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ করোনা প্রতিরোধক এন্টিবডি তৈরী হয়। উপরন্তু ভ্যাকসিন দেয়া ৭৪৩ জনের কারও কোনো তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। সিনোভ্যাক খুব শীঘ্রই ফেইজ-১/২ ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। আশা করি ফলাফল প্রকাশের পর তা যথাযত পর্যালোচনার পর সরকার তার অনুমোদন দিবে।

সমস্যা হলো সিনোভ্যাক এখনো তাদের ফেইজ-১/২ ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করে নি। ফলাফল প্রকাশ না করলে একটি ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ বা এর প্রকৃত কার্যকারিতা কেমন তা বোঝা যায় না। এছাড়া একটি ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞদের মতামত জানা যায়। ফেইজ-৩ ট্রায়াল অনুমোদন দেয়ার পূর্বে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সেসব মতামত পর্যালোচনা করা অতীব জরুরি। তাই ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশের পর তা যথাযত পর্যালোচনার পর সরকার তার অনুমোদন দেয়াই সমীচীন হবে।

চাইনিজ করোনা ভ্যাকসিনের কথা আসলে প্রথমেই আসে ক্যানসিনো বায়টেক কোম্পানির তৈরী আধুনিক পদ্ধতির নিষ্ক্রিয় এডেনোভাইরাস দিয়ে তৈরী ভ্যাকসিন, Ad5-nCoV. ক্যানসিনো বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিনটির তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করতে চাইলে বিবেচনা করা সহজ হতো। কারণ মানুষে এই Ad5-nCoV ভ্যাকসিনটির তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং এটির গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া চীন সরকারও এই ভ্যাকসিনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ চীন সরকার ইতিমধ্যে এই ভ্যাকসিন চীনের মিলিটারিতে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে Ad5-nCoV ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল করাই অধিক যুক্তি সঙ্গত।

পরিষ্কার ভাবেই অক্সফোর্ডের ChAdOx1 nCoV-19, মডার্নার mRNA-1273, ক্যানসিনো বায়টেক কোম্পানির Ad5-nCoV, ফাইজার/বায়োএনটেক এর BNT162b2 ভ্যাকসিনগুলো তীব্র কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়া পর্যাপ্ত ভাইরাস প্রতিরোধক এন্টিবডি তৈরী করে। বাংলাদেশ এগুলোর যেকোনো একটি ভ্যাকসিন কে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের অনুমতি দিলে বেশি উপকৃত হবে।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিশ্বব্যাপী চাহিদার কারণে বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিন গুলোর যে কোনো একটির তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা করানো সহজ হবে না। তথাপি শুধুমাত্র পর্যাপ্ততার কারণে প্রকৃত তথ্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ না করে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

বিজ্ঞানীদের প্রধাণ কাজ ভ্যাকসিন তৈরী শেষ হলো। এখন সচেতন মানুষের জন স্বার্থে ট্রায়ালে অংশ নেয়া প্রয়োজন। তবে তার জন্য প্রথমে সরকারের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞদের একটি নিরাপদ ও কার্যকরী ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন দিলে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top