Scientific Bangladesh

আর্সেনিক – সরকারের অলসতায় বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি, পরিণতি হবে ভয়ংকর

কৃষি নির্ভর অর্থনীতি বাংলাদেশ। এ কৃষি আবার বন্যা, খরা আর লবনাক্ততা দ্বারা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সহ আশেপাশের দেশগুলোর মাটি ও পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ভয়ংকর জনক ভাবে বেড়েছে। ফলে আমাদের কৃষির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও হুমকির মুখে।
প্রকৃত পক্ষে আর্সেনিক মাটি, প্রাকৃতিক পানি, জীবদেহ এমনকি বায়ু মণ্ডলেও বিদ্যমান। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক নিয়মেই ওয়েদারিং প্রক্রিয়া ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যূৎপাতের ফলে প্রকৃতিতে আর্সেনিক মাত্রা বাড়তে থাকে। তা ছাড়া মানুষ নিজেও এ মাত্রা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে ফসলি জমিতে সেচ, মাটি বা পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বৃদ্ধিতে একটি অন্যতম কারন। এ ছাড়া ফসল উৎপাদনে বহুল মাত্রায় কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার এবং আর্সেনিক যুক্ত মুরগীর খাবারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় আরেক মাত্রায় আর্সেনিকের ক্ষতির mম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
অন্যান্য খনিজ পদার্থের মত আর্সেনিকও মানবদেহের জন্য সামান্য পরিমাণ প্রয়োজন যা আমরা প্রতিদিন শাকসবজি সহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এর পরিমাণ একটু বেশী হলেই স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর বিপদ জনক হয়ে পড়ে। আমরা কিন্তু প্রতিনিয়ত বিশুদ্ধ খাবার পানির সাথেও সামান্য পরিমাণে আর্সেনিক গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি লিটার পানিতে ০.০১ মিলি গ্রাম পর্যন্ত সহনীয়। আর এর মাত্রা যদি ০.০৫ মিলিগ্রাম হয় তা হলে সেই পানি পান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, স্বাস্থ্যের জন্য মারাক্তক হুমকি স্বরূপ। 
আর্সেনিক সাধারণত কিডনি বা লিভারের কোষের ভিতরে ঢুকে সেলের ফসফরাসকে প্রতিস্থাপন করে কোষে শক্তি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং কোষ গুলো মারা যায়। ফলশ্র“তিতে লিভার, কিডনি, ফুসফুস ইত্যাদি ক্যান্সারাক্রান্ত হয়। তা ছাড়া আর্সেনিক রক্ত সংবহনে বাঁধা দেয়ার ফলে অ্যানিমিয়া, লিউকোপেনিয়া দেখা দেয় এবং অস্থিমজ্জায় পচন ধরে। আর্সেনিকের কারণে ইতিমধ্যে আর্সেনিক উপদ্র–ত এলাকায় অনেকেই (৬০ শতাংশ) কঠিন রোগে ভুগছেন, এমনকি রোগের প্রকোপ ঠেকাতে অনেকের হাত পায়ের আঙ্গুলও কেটে ফেলতে হয়েছে। আর এ ভাবে প্রতিনিয়ত আর্সেনিক যুক্ত পানি ও খাবার গ্রহণ করে বাংলাদেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই আর্সেনিকের কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, প্রাণ হারানোর ধারা রোধ দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
আক্রান্ত এ জনগুষ্ঠির অধিকাংশই গ্রামীণ জনপদের অধিবাসী হলেও শহর এলাকায়ও এ সমস্যা বিরাজমান। খরা মৌসুমে সেচ দিয়ে ধান বা অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদনের সময় সেচের পানির সাথে মাটির গভীরের আর্সেনিক ফসলী জমিতে চলে আসে। আর এ ভাবে ফসল উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার অব্যাহত বৃদ্ধির কারণে আর্সেনিকের মাত্রা উদ্বেগ জনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে চাল সহ অন্যান্য ফসলে আর্সেনিকের উপস্থিতির মাত্রা বেড়েই চলেছে। উৎপাদিত ফসলের বিরাট অংশের গ্রহীতারা হচ্ছে শহরবাসী। শহরবাসীরা আর্সেনিক উপদ্রুত এলাকায় বসবাস না করেও কিন্তু আর্সেনিকের ভয়াবহ বেষ্টনীয় বাইরে কিন্তু থাকতে পারছি না। মাটিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় যেমন আমাদের জন্য টক্সিক হয়েছে তেমনি ক্যান্সার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। আর এ সমস্যা বাংলাদেশে যেমন বেড়েছে তেমনি সমস্যাটি পৃথিবী জুড়ে।
বিশেষত বাংলাদেশের যে সকল অঞ্চলে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ হয় সে সব স্থানেই আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশী। বলা হয় যে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করার জন্য প্রচুর পানি সেচ দিতে হয় যার অধিকাংশই আসে অগভীর নলকূপ থেকে, এতে পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। তাছাড়া ভারত থেকে শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন বাধের কারণে পানির প্রবাহ কমে যাওয়াতে এমনিতেই আমাদের দেশে পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বেশী মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীট নাশক ব্যবহার করার ফলে জমিতে থাকা অব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ গুলো চুইয়ে মাটির স্তর গুলোতে ঢুকে মাটির খনিজের সাথে বিক্রিয়া করে ফলে মাটিতে বিদ্যমান আর্সেনিক মুক্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে মুক্ত আর্সেনিক চুয়ানো পানির সাথে ভূ-গর্ভের পানিতে মিশছে।
আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত মানুষগুলো অকাল মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে। দিন দিন বাড়ছে। বাড়বে আরও। এই বিশাল জনগুষ্ঠিকে আর্সেনিক বিষ থেকে বাঁচানোর দ্রুত ও ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। মজার ব্যাপার হলো অদ্যাবধি যত সরকারী বা বেসরকারি উদ্যোগ যা নেয়া হয়েছে তা শুধু আর্সেনিকের উপস্থিতি নিরূপণ বা তার উপস্থিতির মাত্রা নির্ণয়েই দীর্ঘ ১০-১৫টি বছর পার হয়ে গেল। আর্সেনিক এখন মহাদূর্যোগ এ পরিণত হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই, অনেকেই ধুঁকছেন। আর্সেনিক থেকে মুক্তির উপায় বের হলো না এখনও। সরকার যেন পণ করেছে দেখেও না দেখার । এদিকে ভারত সরকারের বৈরী মনোভাব এবং একের পর এক বাধের ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি প্রবাহ দিন দিন কমেই যাচ্ছে। আর এ প্রবাহ বাড়ানের কোন সম্ভাবনাও দেখছি না। তাই সরকারের বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
আর্সেনিক উপদ্রুত এলাকায় সাধারণ মানুষের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আর্সেনিক মুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে, মাটি থেকে আর্সেনিক সরিয়ে ফেলার। মাটি থেকে আর্সেনিক সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটি বলা যত সহজ কাজটি তত সহজ হবে না যদি না ভূ-পৃষ্ঠের চলমান পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর এ লক্ষে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে কূটনৈতিক স¤পর্ক জোরদার করতে হবে। নদী নালা, খাল-বিলে পানি ধরে রেখে, শীত মৌসুমে ফসলী জমিতে সেচে ভূ-গর্ভ¯হ পানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। এছাড়া ফসলি জমিতে বিদ্যমান আর্সেনিকের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে। পযাপ— গবেষণা প্রয়োজন মাটি থেকে আর্সেনিক সরিয়ে ফেলার সাশ্রয়ী ও সহজতর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের। সাধারণত মানুষ বা গৃহপালিত প্রাণীর খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, এমন স্বল্প সময়ের উদ্ভিদ পতিত জমিতে চাষ করে জমির উপরি ভাগের আর্সেনিকের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এ ধরনের আর্সেনিক হাইপার অ্যাকুমুলেটর উদ্ভিদ নির্বাচনের জন্য শেরে বাংলা কৃষি বিশ¡বিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা চলছে।

প্রকাশিত সব তথ্য আর মতামত লেখকের আর মন্তব্য কারীর ব্যক্তিগত সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশের নয়। সাইয়েন্টিফিক বাংলাদেশ আইনগত বা অন্য কোন দায় গ্রহণ করবে না তথ্যের সঠিকতা বা পাঠকের মন্তব্যের জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top