Scientific Bangladesh

জীবনের জন্যঃ প্রোবায়োটিক

প্রফেসর সাইফুদ্দিন একরাম

আজকাল প্রোবায়োটিক সম্পর্কে এত বেশী প্রচার-প্রচারণা হয়, তাতে অনেকের মনেই এমন ধারণা হতে পারে যে এটা বুঝি ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম থেকে শুরু করে ক্যান্সার সব কিছুই নিরাময় করার যাদুকরী ওষুধ।

প্রোবায়োটিক শব্দের অর্থ জীবনের জন্য। আমাদের শরীরের ভিতরে নানারকম জীবাণু বাস করে। এদের প্রোবায়োটিক বলা হয়। এরা ব্যাকটেরিয়া কিংবা ইস্ট। শরীরের ভিতরে যে সকল জীবাণু থাকে, তাদের সবাই কিন্তু আমাদের ক্ষতি করে না। কিছু জীবাণু আমাদের বন্ধু। সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের শরীরে এসব জীবাণুর উপস্থিতি বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। মূলত পরিপাক নালীতে এসব জীবাণু থাকলে আমাদের নানারকম উপকার হয়। 


শরীরের ভিতরে আনুমানিক ৪০০ রকমের জীবাণু বাস করে। গড়পড়তা একজন মানুষের শরীরে ৩ থেকে ৪ কেজি আন্ত্রিক জীবাণু থাকে। অর্থাৎ খুব সহজে আন্দাজ করা যায় কি বিপুলসংখ্যক জীবাণু আমাদের শরীরে বাস করে। অবশ্যই বিনা কারণে এত জীবাণু শরীরে বাস করে না। এরা আমাদের সঙ্গে থাকে; কারণ এদের প্রয়োজন রয়েছে।


এধরনের জীবাণু প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করলে আমাদের পরিপাক নালীর কাজকর্ম ভালো থাকে। প্রোবায়োটিক আমাদের অন্ত্রের উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে; এর ফলে পরিপাক নালীর কাজকর্মই শুধু ভালো হয়, তা নয়। সামগ্রিকভাবে তা শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 


প্রোবায়োটিক কেন দরকার? পরিপাক নালীর কাজ-কর্ম ভালো ভাবে চলার জন্য আমাদের প্রচুর বন্ধু জীবাণু দরকার হয়। এসব বন্ধু জীবাণুই প্রোবায়োটিক। এদের মূল কাজ হলোঃ


• এরা পরিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে
• বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন তৈরি করে
• বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান নিষ্ক্রিয় করে
• অন্য ক্ষতিকর জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
• ক্ষতিকর জীবাণুর অতিরিক্ত বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। 


সকল প্রোবায়োটিক কি একই রকম? অবশ্যই না। প্রতিদিন প্রোবায়োটিক গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু সব প্রোবায়োটিক একই রকম কাজ করে না। বিভিন্ন প্রোবায়োটিকের ভিতরে বিভিন্ন ধরণের জীবাণু থাকে। একেক জীবাণু একেক রকম কাজ করে। 


প্রোবায়োটিকের গণ প্রজাতি আলাদা হলে সুবিধা কিংবা অসুবিধা কি? আমরা যে সকল প্রোবায়োটিক গ্রহণ করি তার ভিতরে কোন প্রজাতির জীবাণু আছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণ, প্রজাতি এবং স্ট্রেইনের ওপর প্রোবায়োটিকের কার্যকারিতা নির্ভর করে। সকল প্রোবায়োটিক আমাদের জন্য নিরাপদ হলেও, সব প্রোবায়োটিক আমাদের একই রকম উপকার করতে পারে না। এজন্য প্রোবায়োটিক গ্রহণ করার সময় আমাদের দেখতে হবে তার ভিতরে কোন ধরণের জীবাণু আছে। 


সঠিক জীবাণুযুক্ত প্রোবায়োটিক গ্রহণের পরেও কথা রয়ে যায়। গৃহীত প্রোবায়োটিক কি যথাযথভাবে পাকস্থলী থেকে অন্ত্রে পৌঁছতে পারছে? কারণ পাকস্থলীর অম্লীয় রসের মধ্য দিয়ে পার হওয়ার সময় অনেক প্রোবায়োটিক জীবাণু মরে যায়। অতএব প্রোবায়োটিকের উপকার পেতে হলে এসব জীবাণুকে অবশ্যই পাকস্থলীর অম্লীয় পরিবেশ অতিক্রম করতে পারতে হবে। যেমন সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ল্যাক্টোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস পাকস্থলীর অম্ল এবং পিত্তরস উভয়ের মধ্যেই বেঁচে থাকতে পারে। 


আমাদের প্রোবায়োটিক গ্রহণ করা কি প্রয়োজনীয়? বাস্তবতা হচ্ছে খুব কম মানুষই বলতে পারে তার খাওয়া দাওয়া এবং জীবনাচরণ সঠিক মতো চলছে। সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ব্যায়াম করে এবং উপযুক্ত প্রোবায়োটিক গ্রহণ করে সঠিক জীবনাচরণ পালন করার চেষ্টা করতে পারি। আমাদের পরিপাকতন্ত্রের বন্ধু জীবাণুসমূহ অনেকসময় আমাদের ভুলেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমনঃ
• অতিরিক্ত মদ্যপান
• অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ
• আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া
• অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড গ্রহণ করা
• বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান গ্রহণ করা
• অন্ত্রের নানাধরনের জীবাণু সংক্রমণ
• অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। 


বাজারে প্রোবায়োটিক ট্যাবলেট, পাউডার, ড্রিংক কিংবা দধি আকারে পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসকল প্রোবায়োটিকের মধ্যে ল্যাকটোব্যাসিলাস এবং বাইফিডোব্যাক্টেরিয়াম থাকে। এধরনের জীবাণু আমাদের অন্ত্রে প্রতিনিয়ত স্বাভাবিকভাবেই বসবাস করে। কিছু প্রোবায়োটিকের মধ্যে স্যাকারোমাইসিস বুলারডি নামে পরিচিত ইস্ট থাকে। 


প্রোবায়োটিকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এগুলি নিরাপদ। কারণ এরা এমনিতেই আমাদের অন্ত্রে বাস করে। প্রতিদিন দই এবং দুধের মাধ্যমেও আমরা প্রচুর প্রোবায়োটিক গ্রহণ করি। 


প্রশ্ন হচ্ছে প্রোবায়োটিক ওষুধের মতো গ্রহণ করলে আমাদের কি আসলে কোন উপকার হয়? বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করার ফলে যে ডাইরিয়া হয় তার চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক ভালো কার্যকরী। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক খেলে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে এটা প্রায় অর্ধেক প্রতিরোধ করা যায়।
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক প্রচুর ব্যবহার করা হয়। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের রোগীদের অধিকাংশ সময় পেট ফাঁপা, অতিরিক্ত গ্যাস, পাতলা পায়খানা কিংবা কষা থাকে। গবেষণার ফলাফলে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের চিকিৎসায় প্রোবায়োটিকের ভূমিকা তেমন জোরালোভাবে প্রমাণিত হয় নাই।
প্রোবায়োটিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় বলে মনে করা হয়। এজন্য বিভিন্ন অ্যালার্জি এবং অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় এটা ব্যবহার করা যাবে বলে অনেকে মনে করেন। তবে এ সম্পর্কে আসলে তেমন কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় নাই। 


বাজারের প্রোবায়োটিক ব্যবহারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে এর মধ্যে মাত্র কয়েক রকম জীবাণু খুব অল্প পরিমাণে থাকে। ফলে আমাদের পরিপাক নালীর সমস্যা নিরাময়ের জন্য যে সকল জীবাণু যে পরিমাণে দরকার, তা সব সময় পাওয়া যায় না। আর বার বার কালচার করে এ সকল জীবাণুর বংশবৃদ্ধি করানো হয় বলে এদের জীবনীশক্তিও খুব ক্ষীণ হয়। সর্বোপরি পাকস্থলীর অম্লীয় পরিবেশ পার হয়ে এরা অন্ত্রে সক্রিয় অবস্থায় প্রবেশ করতে পারে কিনা সে বিষয়েও অনেকে সন্দিহান। 


“মল প্রতিস্থাপন”


আসল প্রোবায়োটিক পেতে হলে মানুষের মল বা বিষ্ঠার মধ্যেই একে খুঁজতে হবে। কারণ এছাড়া আসল প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিক পাওয়া সম্ভব না। এজন্য অনেকে অন্য এক ধরণের প্রোবায়োটিক চিকিৎসার কথা চিন্তা করছেন। এ প্রোবায়োটিক ওষুধের দোকানের সেলফে পাওয়া যাবে না। এক সময়ে এটা “হলুদ সুপ” নামে পরিচিত ছিল। আজকাল একে “মল প্রতিস্থাপন” বা “মল ব্যাকটেরিওথেরাপি” বলা হয়। সম্ভবত এটাই প্রকৃত প্রোবায়োটিক চিকিৎসা। তবে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন রয়েছে। তবে এভাবে একজন সুস্থ মানুষের মল থেকে সংগৃহীত প্রোবায়োটিক রোগীর অন্ত্রে প্রতিস্থাপন করা হলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। 


ওষুধ প্রতিরোধী ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিলি সংক্রমণের ক্ষেত্রে “মল প্রতিস্থাপন” চিকিৎসা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। 


অনেকে আশা করছেন ভবিষ্যতে “মল প্রতিস্থাপনের” হয়তো শোভন কোন সংস্করণ বের হবে যেটা দুধ কিংবা দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে গ্রহণ করা যাবে। ততদিন পর্যন্ত যে “হলুদ সুপ”-ই সর্বোৎকৃষ্ট প্রোবায়োটিক, তা বলাই বাহুল্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top