Scientific Bangladesh

জীবাশ্ম-জ্বালানির সমস্যা এবং জৈব-জ্বালানির সম্ভাবনা-

ড. জাবেদ হোসাইন

2017-04-05 01:24:26

বর্তমান যান্ত্রিক বিশ্বে প্রযুক্তিগত যত উন্নয়ন ও অগ্রগতি, তাতে ফুয়েল বা জ্বালানির ভূমিকা অপরিহার্য। আজকের এই আধুনিক জীবন যেমন যন্ত্র ছাড়া অবান্তর, তেমনি জ্বালানি ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতা অসম্ভব। গোটা বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় আশি ভাগেরও বেশি যোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি; বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানি। বলা যায় জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর আমরা আজ অনেকাংশে নির্ভরশীল। অন্যদিকে এই চরম নির্ভরশীলতাই আমাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। গোটা বিশ্ব আজ জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যার পেছনে রয়েছে মুলত তিনটি কারণ; অনিশ্চিত জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ এবং তেল ভিত্তিক ভূ-রাজনীতি।

 

সারা বিশ্বে প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে যানবাহন আর শিল্প-কারখানা। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্বালানি চাহিদা। ২০০৭ সালের এক হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে মোট যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৮০৬ মিলিয়ন, যা ২০৩০ সালের দিকে ১.৩ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের দিকে ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য তরল জ্বালানির ব্যাবহার ছিল প্রতিদিন ৮৫.৭ মিলিয়ন ব্যারেল, যা ২০৩৫ সালের দিকে ১১২.২ মিলিয়ন ব্যারেলে পৌঁছাবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা বিশ্বে সব ধরনের জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যাবহার ছিল শূন্যের কোটায়, যা ক্রমবর্ধমান ভাবে বেড়ে গত শতকের শেষ দিকে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭,৫০০ মিলিয়ন টন প্রাকৃতিক গ্যাস, ৬,০০০ মিলিয়ন টন পেট্রোলিয়াম তেল এবং ২,০০০ মিলিয়ন টন কয়লা। অন্যদিকে জীবাশ্ম-জ্বালানির সঞ্চিত ভান্ডার সীমিত ও অ-নবায়নযোগ্য, এবং ধারনা করা হচ্ছে আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে এই মজুদ নিঃশেষ হয়ে যাবে।

 

জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল এই জ্বালানি পোড়ানোর ফলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ এবং পরিবেশে অস্বাভাবিক ভাবে এসব গ্যাসের জমা হওয়া, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারন হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির অনেকগুলো ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং জীব বৈচিত্র্য হ্রাস অন্যতম। গ্রিন হাউজ গ্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড যার পরিমাণ জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান ছিল শুন্যের কাছাকাছি, অর্থাৎ মোট নিঃসৃত এবং ব্যবহৃত গ্যাসের মধ্যে একটি সমতা ছিল, ছিল ভারসাম্য। অথচ ক্রমবর্ধমান জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ২০১২ সালে পরিবেশে এই গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায়  ১০,০০০ মিলিয়ন টন।

 

তেল উৎপাদন ও বিপণনে বৈশ্বিক রাজনীতিও বর্তমানে একটি উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্তুরের দশকে আরব দেশগুলোর তেল অবরোধের কারনে পুরা বিশ্বে জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল এবং তেলের সরবরাহ মারাত্নক ভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। অন্যদিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাত করে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বর্তমানে অনেক তেল উৎপাদনকারী দেশ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে।

 

সুতরাং, একটি টেকসই, অর্থনৈতিক ভাবে কার্যকরী এবং পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজে বের করা আমাদের শিল্প এবং ভোক্তা সমাজের সময়ের দাবি। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে জৈব-জ্বালানি (বায়োফুয়েল) সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সম্ভাবনাময়। জৈব-জ্বালানি হল তরল বা বায়বীয় জ্বালানি যা উৎপাদন করা যায় যে কোন ধরনের নবায়ণযোগ্য জৈব উৎস (বায়োমাস) থেকে। সামগ্রিকভাবে এসব উৎসকে মোটামোটি চার ভাগে ভাগ করা যায় ; (১) দ্রবীভুত  একক অনু্র শর্করা (চিনি) সমৃদ্ধ বায়োমাস (যেমনঃ আখের রস), (২) শ্বেতসার (স্টার্চ) সমৃদ্ধ বায়োমাস (যেমনঃ ভূট্টা, গম, আলু ইত্যাদি), (৩) সেলুলোজ ও হেমিসেলুলোজ সমৃদ্ধ বায়োমাস (যেমনঃ ফসল সংগ্রহের পর ফেলনা অংশসমুহ , কচুরিপানা , বিভিন্ন ধরনের কাঠ , ঘাস , লতা-পাতা , পৌর বর্জ্য ইত্যাদি ) এবং (৪) আণুবীক্ষণিক শৈবাল । প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকারের বায়োমাস থেকে তৈরি জৈব-জ্বালানিকে বলা হয় প্রথম প্রজন্মের জৈব-জ্বালানি। আর ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর উৎস থেকে প্রাপ্ত জৈব-জ্বালানিকে বলা হয় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের জৈব-জ্বালানি।

 

জীবাশ্ম-জ্বালানির তুলনায় জৈব-জ্বালানি বিভিন্ন ভাবে সম্ভাবনাময়। এই সম্ভাবনা বা সুবিধাগুলোকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যায়; পরিবেশগত, জালানি নিরাপত্তা বিষয়ক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। জৈব-জ্বালানির ব্যাবহার বায়ু-দুষণ এবং গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ কমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অধিকন্তু, যেহেতু বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য (কৃষিজাত ও পৌর) থেকেও জৈব-জ্বালানি তৈরি করা যায়, সেহেতু এই ধরনের জ্বালানির উৎপাদন সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করবে। অন্যদিকে একটি কার্যকর জালানি নিরাপত্তার উৎস হতে পারে জৈব-জ্বালানি, কারন এই জ্বালানি স্থানীয় উৎস থেকে স্থানীয় ভাবে উৎপাদন, পরিবহণ ও বিপণন করা যায়। অর্থনৈতিক ভাবেও জৈব-জ্বালানি বিভিন্ন কারনে প্রতিশ্রুতিশীল। মোটামুটি স্থিতিশীল মূল্যের জৈব-জ্বালানি একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা যা আন্তর্জাতিকভাবে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক। সর্বোপরি, এই ধরনের জ্বালানি ব্যবস্থা গ্রামীন ও কৃষি উন্নয়ন, এবং নতুন কর্ম সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।

 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে জৈব-জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যাবহারে নীতিগত ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমুহ ২০২০ সালের মধ্যে বিকল্প জ্বালানির মাধ্যমে ২০% জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যাবহার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্র ২০২৫ সাল নাগাদ তাদের মোট আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ ভাগ বিকল্প জ্বালানি দ্বারা প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌর শক্তি, বায়ু চালিত শক্তি, জলবিদ্যুৎ, এবং ক্ষেত্রবিশেষে বায়োগ্যাসের মত বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। তাছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাস এবং জ্বালানি নিরাপত্তার প্রয়োজনে জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের জন্য “টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১২” প্রনীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণা কিংবা সরকারী নীতিতে জৈব-জ্বালানির মত সম্ভাবনাময় জ্বালানি ব্যবস্থাটি বলা যায় অনেকটা উপেক্ষিত। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের জ্বালানি ব্যাবস্থার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, এবং জৈব-জ্বালানির উৎপাদন ও বিপণন আমাদের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে আরো গতিশীল করবে।

 

জৈব-জ্বালানির মধ্যে বায়ো-ইথানল, বায়ো-মিথানল, বায়ো-বিউটানল, বায়ো-ডিজেল, বায়োগ্যাস এবং বায়ো-হাইড্রোজেন অন্যতম। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হল বায়ো-ইথানল, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে শিল্প-পরিসরে উৎপাদন এবং ব্যাবহার চালু হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য হল ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডা এবং ইউরোপের কিছু দেশ। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বায়ো-ইথানল তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বিকল্প জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান “রিনিউএবল ফুয়েল এসোসিয়েশন” এর ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইথানল উৎপাদন হয়েছিল ১৭৫ মিলিয়ন গ্যালন যা ২০১৫ সালে পৌঁছায় ১৪,৮১০ মিলিয়ন গ্যালনে। আশা করা হচ্ছে সারা বিশ্বে এই জৈব-জ্বালানি আগামী ২০ বছরে পরিবহন খাতে অন্যতম প্রাধান্য বিস্তারকারী বিকল্প জ্বালানি হিসেবে পরিগণিত হবে। ইথানল সাধারণত পেট্রোলের সঙ্গে বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত করে প্রচলিত ইঞ্জিনে অথবা বিশুদ্ধ ইথানল হিসেবে বিশেষভাবে পরিবর্তিত ইঞ্জিনে ব্যাবহার করা হয়। তবে মিশ্রিত ইথানল বিশেষ করে ১০ ভাগ ইথানল এবং ৯০ ভাগ পেট্রোলের মিশ্রণ (যাকে বলা হয় ই-১০) যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।

 

সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে জৈব-জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা যদিও অত্যধিক, কতিপয় চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে এই জ্বালানী ব্যবস্থাকে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সুবিধাজনক টেকনোলজি ও জীবাশ্ম-জ্বালানির সাথে প্রতিযোগীতামূলক উৎপাদন খরচ, গ্রহণযোগ্য জৈব-জ্বালানি নীতি, গবেষণা ও শিল্পায়নে পর্যাপ্ত ভর্তুকি, এবং কার্যকর বায়োমাস সংগ্ররহ চেইন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মজুদ। সর্বোপরি, কিছু সমালোচনা এবং নৈতিক বিতর্ককে মোকাবেলা করতে হবে এই জ্বালানি ব্যবস্থাকে। আর সর্বপ্রথম যে বিতর্কটি আসছে তা হল “খাদ্য-শস্য ব্যবহার করে জ্বালানি উৎপাদন কতটা যুক্তি সংগত”? অবশ্য এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। তবে বিতর্ক যাই হোক খাদ্য-শস্য নির্ভর জৈব-জ্বালানির বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় প্রজন্মের জৈব-জ্বালানিকেই বর্তমানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশ এ লক্ষ্যে কাজ করছে। ইতোমধ্যে এই ধরণের জৈব-জ্বালানির বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অতএব সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন “আজকের বর্জ্য” হবে “আগামী দিনের জ্বালানি।”

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top