Scientific Bangladesh

ইনডেক্স ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড ২০১৯

ইনডেক্স ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ৬ সেপ্টেম্বর এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হলো। ‘দ্য প্ল্যান্ট’ নামে একটি বহুতল হলরুমে জমকালো সেই অনুষ্ঠান ছিল এককথায় চোখ ধাঁধানো।

টেলিভিশনে বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান দেখলেও সামনাসামনি এটাই ছিল আমার জন্য প্রথম। পুরস্কারের অর্থমূল্যও কম নয়। এক লাখ ইউরো করে পাবেন একেকজন বিজয়ী। বাংলাদেশি প্রায় এক কোটি টাকার কাছাকাছি। স্বভাবতই একপ্রকার উত্তেজনা কাজ করছিল।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দেশটির ক্রাউন প্রিন্সেস। পাঁচটি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার। আমাদের এই ধরিত্রীকে বাঁচাতে পারে এমন সব উদ্ভাবনের ওপর পুরস্কার পেয়েছে বিভিন্ন প্রজেক্ট।

পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়াটাও ছিল দারুণ। প্রথমে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে কোন কোন প্রজেক্ট নমিনেশন পেয়েছে, সেগুলো দেখানো হয়েছে। তারপর একজন সেই ক্যাটাগরির বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেছেন। এরপর রয়েছে জুরি কেন সেই প্রজেক্ট নির্বাচন করেছে, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। অতঃপর বিজয়ী টিম মঞ্চে এসে পুরস্কার গ্রহণ করেছে এবং সেই সঙ্গে তাদের প্রজেক্টের ওপর করা একটি ভিডিও দেখানো হয়েছে।

সেই অনুষ্ঠানের তিনটি বিজয়ী প্রজেক্ট এখানে শেয়ার করছি।

ডেনিশ ক্রাউন প্রিন্সেস পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন

প্রজেক্ট ছিলিকালার

‘বডি’ ক্যাটাগরিতে এ বছর ইনডেক্স ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে প্রজেক্ট ছিলিকালার। প্রজেক্টের কর্ণধার নাতসাই সিজা মঞ্চে এসে পুরস্কার গ্রহণ করেন।

সিজার উদ্ভাবনটি ছিল অনেকটাই স্বপ্নে পাওয়ার মতো। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অধ্যাপক জন ওয়ার্ডের সঙ্গে। ওয়ার্ড তখন অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সিজাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন স্ট্রেপ্টোমাইছেস ছিলিকালার নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে। এই ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইনস বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকস উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সিজা লক্ষ করেন, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পিগমেন্টও উৎপন্ন করতে সক্ষম। সিজা ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তাঁর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল, কী করে এই পিগমেন্টকে কাজে লাগানো যায়।

কাপড়ের ডাইং প্রসেস পরিবেশের জন্য কতটা খারাপ ও হুমকি, সেটা সিজা ভালোভাবেই জানতেন। ভাবতে লাগলেন, কীভাবে এই ছিলিকালার বায়ো সলিউশন দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যায়। শুরু করলেন বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি লক্ষ করলেন, কাপড়ে সরাসরি এই ব্যাকটেরিয়া জন্মানো হলে তা যে পিগমেন্ট উৎপন্ন করে, সেটা সরাসরি কাপড়ে লেগে যায়। এতে করে শুধু কেমিক্যালের ব্যবহারই বন্ধ হবে না; বরং এটা ট্র্যাডিশনাল ডাইং প্রসেস থেকে অনেক দ্রুত হবে। এ ছাড়া প্রায় পাঁচ শ গুণ পানির অপচয় রোধ করবে। সিজা ‘ফ্যাবার ফিউচার’ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই কোম্পানি সাসটেইনেবল ফিউচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। টেক্সটাইল শিল্পের বায়োফেব্রিকেশনে সিজারের উদ্ভাবন যেন এক মাইলফলক।

প্রজেক্ট পিসিস

জেলেদের কাজে সহায়তা করে ‘ওয়ার্ক’ ক্যাটাগরি থেকে পুরস্কার জিতেছে প্রজেক্ট পিসিস। জেলেরা যখন মাছ ধরতে নদীতে বা সমুদ্রে যান, তখন দেখা যায় অনেক অপ্রত্যাশিত মাছ, যেগুলো তাঁরা ধরতে চান না, সেগুলো উঠে আসে। সর্টিংয়ের সময় সেই মাছগুলোকে ফেলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে জেলে হয়তো জাল ফেলে ঘণ্টার পড় ঘণ্টা বসে আছেন, এদিকে মাছের কোনো খবর নেই। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাবে বিশ্বে প্রতিবছর ২৭ মিলিয়ন টন মাছ নষ্ট হয় শুধু অপ্রত্যাশিত মাছ উঠে আসার কারণে।

ইনোভেশন করতে হলে সমস্যা খুঁজে বের করতে হয়। গল্পের শুরু ড্যান ওয়াটসনকে দিয়ে। ২০০৮ সালের কথা, তখন তিনি ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোতে প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। সে সময়েই প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ ধরার কারণে মাছ নষ্ট হওয়ার বিষয়টি লক্ষ করেন ওয়াটসন। সেই থেকে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকেন। কীভাবে সাধারণ কিছু ব্যবহার করে জেলেদের মাছ ধরার সময় কমানো যায়? জেলেরা যে মাছ ধরতে গেছেন, শুধু সেই মাছই ধরা পড়বে, কী করে এটা নিশ্চিত করা যায়?
এলইডি লাইট ব্যবহার করে ইনডোরে (ঘরের ভেতরে) চাষাবাদ করা মোটামুটি আমরা অনেকে দেখেছি ও জানি। ইনডোর ও ভার্টিক্যাল (উলম্ব পদ্ধতিতে) ফার্মিংয়ে এলইডির ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। ওয়াটসন এই এলইডি লাইটকেই কাজে লাগালেন। গবেষণা করে দেখলেন, একেক রঙের আলো একেক প্রজাতির মাছকে আকৃষ্ট করে। আবার সেই আলোই হয়তো অন্য কোনো প্রজাতির মাছকে দূরে ঠেলে দেয়। জালের ভেতরে লাইট স্থাপন করে মাছ ধরা হলো, সফলতা এল। ‘সেফটিনেট টেকনোলজি’ নামে তাঁরা একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ড্যানের টিমের এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে উপকৃত হবে ফিশিং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই। ভোক্তা ও সর্বোপরি প্রকৃতি।

বিজয়ী তিনটি প্রজেক্ট

প্রজেক্ট সোলার ফুড

ছোটবেলায় খেতে না চাইলে আম্মু রাগ হয়ে বলতেন, ভাত খাওয়ার দরকার নেই, বাতাস খেয়ে থাক। কেমন হবে যদি বাতাস খেয়েই থাকা যায়? আচ্ছা, আমরা যাঁরা পরিবেশ নিয়ে ভাবি, তাঁরা কি জানি আমাদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদনেই টোটাল গ্রিনহাউস গ্যাসের ২৫ ভাগ উৎপন্ন হয়। এমন যদি একটি উপায় পাওয়া যেত, যাতে খাবারও পেতাম, গ্রিনহাউস গ্যাসও কমে যেত, তবে কেমন হতো?

ধরিত্রীকে কোনো রাজনীতিকেরা বাঁচাবেন না। বাঁচাতে পারেন কেবল বিজ্ঞানীরাই। হ্যাঁ, রাজনীতিকেরাই সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সহায়তা করতে পারেন। তবে পথ বের করে দেন বিজ্ঞানীরা। ধরিত্রীকে বাঁচাতেই ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে গেছেন খাদ্যবিজ্ঞানী পাসি ভেইন্নিকা। ফিনল্যান্ডের অধ্যাপক পাসি বিদ্যুৎ, পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে তৈরি করেছেন মানুষের খাদ্য সোলেয়িন। তাঁর কোম্পানির নাম সোলার ফুড। বর্তমানে একটি ফার্মেন্টেশন (গাঁজন) চুল্লি থেকে তাঁরা দিনে এক কেজি করে সোলেয়িন উৎপাদন করছেন। এটি এমন এক প্রযুক্তি, যা ব্যবহার করে মানুষ মঙ্গল গ্রহেও খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে। প্রোডাকশন বাড়াতে হলে তাঁকে শুধু নতুন একটি চুল্লি বসাতে হবে।

সোলেয়িনের শতকরা ৬০ শতাংশ আমিষ, ২০-২৫ শতাংশ শর্করা ও ৫-১০ শতাংশ চর্বি। বর্তমানে পোকামাকড়কে বলা হয় ‘ফুড অব ফিউচার’। ইউরোপে খাদ্য গবেষণায় ইনসেক্ট রিসার্চ একটি নতুন দিগন্ত। কয়েক দিন আগেই জার্মানিতে হয়ে গেল ‘ইনসেক্টা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স’। ফিনিশরা পোকামাকড় খাওয়ায় এগিয়ে গেছে। ফিনল্যান্ডের অনেক বেকারি শপেই রুটি বানানোর সময় প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট হিসেবে এই ইনসেক্টের গুঁড়া ব্যবহৃত হয়। তাদের এই প্রো-অ্যাকটিভ অ্যাটিচুড বিশ্ব গণমাধ্যমে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। সোলেয়িন একই উপায়ে বিভিন্ন খাবার যেমন পাস্তা, রুটি এমনকি বিভিন্ন ড্রিংকসে ব্যবহার করা যাবে। সাসটেইনেবিলিটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে ইনসেক্ট ফুড থেকে সোলেয়িন অনেক এগিয়ে। সোলেয়িনকে বলা হচ্ছে ‘ফুড আউট অব থিন এয়ার’।

প্রকৃতিতে কিছু ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, যারা হাইড্রোজেন অক্সিডাইজিং ব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত। এসব ব্যাকটেরিয়া হাইড্রোজেনকে এনার্জি সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে আর কার্বন ডাই-অক্সাইডকে কার্বন সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। ব্যাকটেরিয়া ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাতাসে অবস্থিত পানি আর কার্বন ডাই-অক্সাইডকে গ্যাস ফার্মেন্টেশন করেই উৎপন্ন হচ্ছে সোলেয়িন। অসাধারণ তাই না!

সোলার ফুড প্রচলিত খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি পরিবেশবান্ধব। প্রচলিত খাদ্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানির তুলনায় সোলার ফুডে অনেক কম পানি ব্যবহৃত হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্ভাবনের জন্য এ বছর ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড জিতেছে প্রোজেক্ট সোলার ফুড।

ড. মোঃ নাহিদুল ইসলাম

ওডেন্স, ডেনমার্ক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top