মু: মাহবুবুর রহমান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখন পর্যন্ত পাঁচটি করোনা টিকা বা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে যেগুলো হলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের করোনা ভ্যাকসিন। আর সর্বশেষ অনুমোদন পেলো চীনের সিনোফার্মের টিকা। পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে উদ্ভাবিত করোনার টিকাগুলোর মধ্যে প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়া টিকা হলো চীনের সিনোফার্মের টিকা যেটি অনুমোদন পায় ৭ই মে ২০২১ তারিখে।
উপরোল্লোখিত পাচঁটি টিকা ছাড়া অন্য যে করোনা টিকা নিয়ে বিশ্বে বেশি আলোচনা হচ্ছে এবং যেটির মানবদেহে প্রয়োগ শুরু হয়েছে সবার আগে সেটি হলো রাশিয়ার উদ্ভাবিত স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন। রাশিয়া সবার আগে করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের ঘোষণা ও দেশটিতে এর প্রয়োগ শুরু করলেও এখন পর্যন্ত স্পুটনিক ভি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি।
তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে তিনটি করোনা টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে তার মধ্যে স্পুটনিক ভি হলো দ্বিতীয় অনুমোদন প্রাপ্ত টিকা। বাংলাদেশ সবার আগে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ও সবশেষ চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দেয়।
ডব্লিউএইচও অনুমোদনপ্রাপ্ত পাঁচটি টিকা ও রাশিয়া উদ্ভাবিত স্পুটনিক ভি টিকার মধ্যে কোনটি কতটা কার্যকর, কোনটির দাম কী রকম, কোনটি পরিবহন ও সংরক্ষণে সুবিধাজনক অর্থাৎ কোন করোনা ভ্যাকসিনের উপযোগিতা কেমন তা নিয়ে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করবো আজকের লেখায়।
কোনটি কত ডোজের টিকা
বিশ্বজুড়ে চলমান করোনা টিকাদান কর্মসূচিতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না, সিনোফার্মের টিকা ও স্পুটনিক ভি টিকা – দুই ডোজের টিকা অর্থাৎ টিকার পূর্ণ কার্যকারিতা পেতে এসব টিকার যেকোনোটি একজনকে দুইবার নিতে হয়। বিশ্বে অনুমোদন পাওয়া করোনা টিকার মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসনের উদ্ভাবিত টিকাটি এক ডোজের টিকা। তবে রাশিয়াও সম্প্রতি একটি একক ডোজের করোনা টিকার অনুমোদন দিয়েছে যার নাম দেয়া হয়েছে স্পুটনিক লাইট।
কোন টিকার কত দাম
বিশ্বজুড়ে করোনা টিকাদান কর্মসূচি চলছে। আর বেশির ভাগ দেশই তাদের নাগরিকদের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে এসব টিকা বিতরণ করছে। তবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়েই দেশগুলোকে টিকা কিনতে হচ্ছে। আর ভারতে খোলা বাজারেও বিক্রি হচ্ছে করোনা ভ্যাকসিন বা টিকা। তবে বাংলাদেশে এখনো খোলা বাজারে করোনা ভ্যাকসিন বা টিকা বিক্রি শুরু হয়নি।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অক্সফোর্ড টিকা কিনতে ভারতের সরকারি পর্যায়ে খরচ হচ্ছে প্রতি ডোজ বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩০ টাকা। তবে দেশটির খোলাবাজারে এ টিকার দাম ধরা হয়েছে প্রতি ডোজ বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি ডোজ ফাইজার টিকার দাম ধরা হয়েছে ১৬৫০ টাকা, মডার্নার টিকা প্রায় ৩০০০ টাকা, চীনের সিনোফার্মের টিকা ৬৫০০ টাকা, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি টিকা ৮৪৬ টাকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা ৮৪৬ টাকা।
তবে একটু বলে রাখা প্রয়োজন যে টিকার প্রকৃত দাম জানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না কারণ দামের বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে। আর বিশ্বের টিকা উৎপাদনকারী কোনো কোম্পানিই এখন পর্যন্ত খোলা বাজারে করোনা টিকা বিক্রির দাম নির্ধারণ করেনি।
টিকা পরিবহন ও সংরক্ষন
টিকার কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য এর পরিবহন ও সংরক্ষন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত প্রচলিত টিকাগুলোর মধ্যে ফাইজারের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পরিবহন ও সংরক্ষণ করতে হয়। তবে অক্সফোর্ড, স্পুটনিক ভি, মডার্না, সিনোফার্মের টিকা, ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা স্বাভাবিক পদ্ধতিতে রেফ্রিজারেটরে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পরিবহন ও সংরক্ষণ করা যাবে বলে জানা গেছে।
টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত মানব দেহে প্রয়োগকৃত করোনা টিকাগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রায় একই রকম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জরিপ অনুযায়ী কোভিড-১৯ টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার হার খুবই অল্প মাত্রার। প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বাহুতে যেখানে টিকাটি দেয়া হয়- টিকা দেয়ার স্থানটি ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়- কারণ তখন দেহে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
টিকা দেয়ার পর দেহের বাকি অংশে এর প্রভাব পড়তে পারে এবং দেখা দিতে পারে ফ্লুর মতো উপসর্গ যেমন জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা এবং বমি বমি ভাব। তবে এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার কয়েকদিনের (সাধারণত ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা) মধ্যেই সেরে যায়। প্রথম ডোজ পরবর্তী ও দ্বিতীয় ডোজ পরবর্তী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় তেমন বেশি তারতম্য হয় না বলে জানা গেছে।
টিকার কার্যকারিতার তুলনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত করোনার কোনো টিকাই শতকরা ১০০ ভাগ কার্যকর নয়। জানা গেছে, ফাইজারের দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হলে করোনা প্রতিরোধে শতকরা ৯৫ ভাগ সুরক্ষা দেবে, সম পরিমাণে মর্ডানার টিকা দেয়া হলে শতকরা ৯৪ ভাগ সুরক্ষা দেবে। অন্যদিকে দুই ডোজের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৭০থেকে ৯০ ভাগ কার্যকর, স্পুটনিক ভি কার্যকর ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ আর চীনের সিনোফার্মের টিকা ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকর বলে জানা গেছে। এক ডোজের জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার কার্যকারিতা সারা বিশ্বে ৬৬ শতাংশ ও আমেরিকায় ৭২ শতাংশ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন ধরন বা স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা
করোনাভাইরাসের নতুন ধরন বা স্ট্রেইন বা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কার্যকর কীনা সে প্রশ্ন এখন সবার মনে। কারণ সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের হাজার হাজার ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রতিদিনই করোনাভাইরাস তার রূপ পাল্টাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ইউকে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টকে ”উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট” বলে মনে করা হয়।
বিবিসি জানিয়েছে, ইউকে বা কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট (যার আরেক নাম B.1.1.7) প্রথম দেখা গেছে ব্রিটেনে। পরে ৫০টিরও বেশি দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এটি এখনও মিউটেট করছে। ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট (P.1) ছড়িয়ে পড়েছে ১০টিরও বেশি দেশে। এর মধ্যে ব্রিটেনও রয়েছে। এছাড়াও ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিটেনে ইন্ডিয়া বা ভারত ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617 )-এর ২০০টি কেস ধরা পড়েছে।
বিশ্বে এখন যেসব ভ্যাকসিন চালু রয়েছে সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল করোনার মূল ধরনটির চিকিৎসার জন্য। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো কাজ করবে, তবে তার কার্যকারিতা হবে কম। একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, আগে যাদের কোভিড হয়েছে এবং কিছুটা ইমিউনিটি রয়েছে অর্থাৎ দেহে অ্যান্টিবডি থাকলে, ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট সম্ভবত তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে না।
ফাইজারের ভ্যাকসিনের ওপর গবেষণাগারের প্রাথমিক তথ্য এবং রোগীদের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এটি করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে, তবে কার্যকারিতা কম। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে, এটি ইউকে/কেন্ট ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও একইভাবে কার্যকর। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এটি কম সুরক্ষা দেয়। কিছু প্রাথমিক ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে, মডার্না ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে এর ইমিউন রেসপন্স দুর্বল এবং স্বল্পস্থায়ী।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে শতকরা ৬৪ ভাগ কার্যকর। করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে চীনের সিনোফার্ম ও রাশিয়ার স্পুটনিক ভির কার্যকারিতা নিয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
করোনার নতুন ধরন ও বুস্টার ডোজ
প্রতিনিয়তই ধরন পাল্টে নতুন রূপে আবির্ভুত হচ্ছে করোনা ভাইরাস। নিত্য নতুন ধরন বা স্ট্রেইনে মানুষ হয়ে পড়ছে দ্বিধান্বিত। আর তাই অধিক সুরক্ষার জন্য বলা হচ্ছে বুস্টার ডোজ নেয়ার কথা। একক ডোজ কিংবা দুই ডোজ টিকায় কিছু সুরক্ষা হয় ঠিকই, কিন্তু বুস্টার ডোজ গ্রহণ না করলে সেই সুরক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ফাইজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলবার্ট বোরলা ইতোমধ্যে বুস্টার ডোজের কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেন, এমন হতে পারে করোনার টিকা নেয়া লাগতে পারে প্রতি বছর।
গত ১৫ এপ্রিল মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসিতে সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে আলবার্ট বোরলা করোনার ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন বা ভ্যারিয়ান্ট ‘মূল ভূমিকা’ পালন করবে উল্লেখ করে বলেন, ‘‘পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্ভবত করোনা প্রতিরোধী টিকার ৩য় বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। সেটা হতে পারে ছয় মাস বা ১২ মাসের মধ্যে। হয়তো প্রতিবছর টিকা নিতে হতে পারে। তবে আগে এসব বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার।’’
করোনা টিকা নেয়ার পরের সাবধানতা
বিশ্বের কোনো করোনা টিকাই শতভাগ কার্যকর নয় কাজেই টিকা নেয়ার পরও যেকেউ করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। আবার টিকা নেয়ার পরও হয়তো করোনাভাইরাস আপনার নাক-মুখের মাধ্যমে দেহে ঢুকতে পারে এবং সেটি আপনাকে আক্রমণ করতে সমর্থ না হলেও আপনার হাঁচি- কাশির মাধ্যমে সেটি অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে।
কাজেই আসুন, করোনার টিকা গ্রহণকারী কিংবা যারা এখনো টিকা পায়নি সবাই আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। মাস্ক পরিধান করা, হাত সাবান-পানি দিয়ে বারবার ধোঁয়া এবং যথাসম্ভব শারীরিক দুরুত্ব মেনে চলা—অন্ততপক্ষে এই তিনটি স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কোনো ঢিলেঢালা ভাব বা উদাসীনতা প্রদর্শন করা যাবে না। বিশ্বের কোথাও মোটামুটি হার্ড-ইমিউনিটি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। আসুন নিজে মাস্ক পরিধান করি এবং অন্যকেও মাস্ক পরিধানে উৎসাহিত করি।
লেখক: মু: মাহবুবুর রহমান; ফার্মাসিস্ট, নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক