চিত্র ১। PFAS এর উৎস সমুহ।
যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন রান্না-বান্নার সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশ কোনটা? তাহলে সবার কাছ থেকে নিশিচত যে উত্তরটা পাবেন তা হচ্ছে রান্নার পর হাড়ি-পাতিল ধোয়া! একইভাবে গায়ের জ্যাকেট বা বাসার সোফায় লেগে যাওয়া ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে বিরক্ত হয় নাই এমন মানুষ খুব কমই আছেন। আর এই সব কিছু থেকে পরিত্রাণ দিতে আমেরিকান কেমিক্যাল কোম্পানি DuPont নিয়ে আসে PFAS যা আমরা সাধারনত টেফলন নামে চিনি। আট কার্বন (C8) বিশিষ্ট এই কেমিক্যাল গুলো (চিত্র ২) এতই স্থায়ী ধাঁচের যে সূর্যের আলো অথবা অণুজীব কোন কিছুই একে ধ্বংস করতে পারে না। যা ফলশ্রুতিতে প্রায় সব ধরণের শিল্পে (চিত্র ১) বর্তমানে এর ব্যবহার হচ্ছে। আর এতেই এই কেমিক্যাল গুলোকে ‘Forever Chemical’ বা চিরন্তন রাসায়নিক যৌগ নামে ডাকা হয়!
চিত্র ২। PFAS যৌগ সমুহের রাসায়নিক গঠন।
এখন এত স্থায়ী এবং এত এত কাজে যেই জিনিসটাকে ব্যবহার করা হয় তাতে ক্ষতিটা কোথায়? সমস্যাটা ঠিক এখানেই। যেহেতু এই যৌগ গুলো কোন ধরণের প্রাকৃতিক শক্তি যেমন সূর্যালোক অথবা অনুজীব কেউই ধ্বংস করতে পারে না তাই এগুলো প্রকৃতিতে রয়ে যায় যুগের পর যুগ। মাটি, পানি আর বাতাস এই সব মাধ্যমে ঢুকে পড়ে জীব জগতের খাদ্য শৃঙ্খলে। বিপত্তিটা ঠিক তখই ঘটে। জীব জগতে স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে নতুন কিছু চলে আসলে তার একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা নানা রকমের রোগ-বালাইয়ের আকারে দেখা যায়। ঠিক এমনটাই দেখে যাচ্ছে এই টেফলন বা PFAS শ্রেণীর যৌগের ক্ষেত্রে। এই যৌগের মূল আবিস্করক কোম্পানি DuPont এর নিজস্ব গবেষণায় বিভিন্ন প্রাণীর উপর ক্ষতিকর প্রভাব বের হয়ে আসে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রাজিল, ভারত সহ অন্যান্য দেশের মানুষের রক্ত পরীক্ষা করে এই যৌগের অস্তিত্ব পেয়েছে। তবে ব্যবসার অসুবিধা হবে এই চিন্তা করে তারা এই গবেষণার ফলাফল গোপন রাখে। বিষয়টা সাধারণ মানুষের নজরে আসে DuPont এর টেফলন প্লান্টে কাজ করা দুইজন নারী কর্মীর বিকলাঙ্গ বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর। যদিও DuPont এটার দাঁয়-দায়িত্ব নেয়নি। তবে ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। DuPont এর ফ্যাক্টরির পাশের একজন কৃষকের খামারের পশুগুলোর যখন নানারকম শারীরিক সমস্যা এবং বিকলাঙ্গ বাছুরের জন্ম দেয় তখন ওই কৃষক DuPont কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে দেন যার রায় কৃষকের পক্ষে আসে। এরপর আশেপাশের আবাসিক এলাকার মানুষজনও মামলা করেন। যেটা DuPont প্রায় ৩2০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেটল করে নেয়। তবে মামলায় অংশগ্রহণকারিরা এই অর্থ দিয়ে একটি বিজ্ঞানী প্যানেল গঠন করেন যারা পরবর্তী ৭ বছর ধরে ৭০ হাজারের বেশি মানুষের উপর এই টেফলন যৌগের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের গবেষণায় উঠে আসে এই যৌগের কারণে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের নানা ধরণের ক্যানসার রোগ, প্রজনন সমস্যা সহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর DuPont কোম্পানির বিরুদ্ধে ৩৫০০ এর উপর ক্ষতিপূরণ মামলা হয়। মামলার বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য DuPont কোম্পানি তাদের টেফলন প্রস্তুতের ইউনিটটি নতুন একটা কোম্পানি Chemours এর কাছে বিক্রি করে দেয়। এখন মামলাকারিদের কে ক্ষতিপূরণ দিবে এটা নিয়ে এই দুই কোম্পানি ফুটবল খেলছে! আগ্রহীরা এ নিয়ে নির্মিত ‘The Devil We Know’ তথ্যচিত্রটি দেখে নিতে পারেন।
১৯৩৮ এ আবিষ্কার হওয়া এই যৌগ নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল অথচ সরকারী সংস্থা যেমন US EPA (United States Environmental Protection Agency) কি করছে? EPA শুরুর দিকে কোম্পানির হয়ে সাফাই গেয়ে যায়। এটা শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন। আমেরিকা মূলত ধনী তথা ব্যবসায়ীদের দেশ। এখানে ব্যবসায়ীরাই আইন-কানুন লবিংয়ের মাধ্যমে ঠিক করেন। আবার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ব্যাক্তিরাই দেখা যায় সরকারী প্রতিষ্ঠানসমুহ যেমন EPA এর দায়িত্বে বসেন। যার ফলে দেখা যায় জনস্বার্থের চেয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। টেফলন এর উৎপাদন ও ব্যবহার এর উপর নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য EPA শেষ পর্যন্ত একটা আইন বানায়। তবে বিগত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেটো দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় সেই আইন আর আলোর মুখ দেখেনি। এবার দেখা যাক পরিবেশ বান্ধব হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই বিষয়ে কি করেন!
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এই টেফলন বা PFAS দিয়ে তৈরি কোন পন্য ব্যবহার হয় কিনা? অবশ্যই হয়। বাজারে যেসব নন-স্টিক হাড়ি-পাতিল বিক্রয় হয় সেগুলো একটু ভালো ভাবে খুজলে দেখা যাবে এর অনেকগুলই টেফলন এর আবরণ আছে। তবে সব নন-স্টিক হাড়ি-পাতিল এ টেফলন বা PFAS ব্যবহার করা হয় না। আপনাকে জেনে নিতে হবে আপনি যে আইটেমটি কিনেছেন সেটাতে টেফলন বা PFAS ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। রান্না-বান্না যেহেতু প্রতিদিনের কাজ, তাই এর মাধ্যমে আমাদের টেফলন বা PFAS এ এক্সপোজ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। তাই নন-স্টিকি হাড়ি-পাতিল এর ব্যবহার বন্ধ করে স্টিল, কাস্ট আয়রন অথবা এলুমিনিয়ামের (যেটাকে আমরা সিল্ভারের পাতিল বলি) ব্যবহার করতে পারেন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে খাবার পানি। এটার জন্য PFAS দুর করতে পারে এই ধরণের পানির ফিল্টার ব্যবহার করুন। আর প্রয়োজন হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কারণ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আইন প্রয়োগ করে এর ব্যবহার সীমিত করতে না পারলে পুরোপুরি মুক্ত থাকা সম্ভব না।
References:
https://www.ewg.org/pfaschemicals/what-are-forever-chemicals.html
https://www.scientificamerican.com/article/forever-chemicals-are-widespread-in-u-s-drinking-water/
https://www.youtube.com/watch?v=NJFbsWX4MJM
https://www.clearlyfiltered.com/blogs/blog/pfas-teflon-contamination-worse-than-previously-thought
https://cen.acs.org/sections/pfas.html