Scientific Bangladesh

উদ্দীপনার খেলাঘর (Play house of Stimuli)

                                                                           উদ্দীপনার খেলাঘর (Play house of Stimuli)

                                                                                                                                 –দিগন্ত পাল

একের মাঝে লভিতে সবে,

সবের মাঝে করি একের সন্ধান।

জীবন এক, জিজ্ঞাসা অনেক। একই সত্যকে গর্ভে ধরে অন্তঃসত্ত্বা অজস্র ঘটনা (ফ্যাক্ট), আর সেই সত্য হলো – ঘটনা সর্বদাই আপেক্ষিক। দুধে যতই চিনি মেশাই না কেন, বিড়াল সেই মিষ্টতা আস্বাদনে অক্ষম। এমন অনেক রঙ আছে যা তোমার-আমার অদেখাই রয়ে গেল কিন্তু মৌমাছি তাদের দেখেছে। একই রচনা কারও অসাধারণ বোধ হয় আবার কারও কাছে তা ভীষণ অপরিণত। প্রবাহী ( তরল বা গ্যাস)  যেমন স্বাকারহীন, ঘটনারও তেমন কোন নিজস্ব পরম (অ্যাব্সলিউট) রূপ নেই কারণ পর্যবেক্ষকের (অবসারভার)  উপলব্ধিই হলো ঘটনার  স্বরূপ যা পর্যবেক্ষক বদলে গেলে বা একই পর্যবেক্ষকের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যেতে পারে – তা সেই পর্যবেক্ষক কোন জীব হোক্  বা যন্ত্র। চোখ কালো চশমায় ঢাকলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনেও সন্ধ্যা নেমে আসে। উপলব্ধি হলো সেই চশমা যার মধ্য দিয়ে জগৎ এক আপাত রূপে প্রতিভাত হয়।

এখন বলাই বাহুল্য যে,পর্যবেক্ষকের মধ্যে যদি উপলব্ধি জন্ম না নেয়,তার কাছে ঘটনাও অস্তিত্বহীন। আমাদের চোখ কেবল ৩৮০ বা ৪০০ ন্যানোমিটার থেকে ৭০০ বা ৭৮০ ন্যানোমিটার সীমার মধ্যে থাকা কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (ওয়েভলেঙ্থ)  তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের প্রতি সংবেদনশীল কিংবা আমরা কেবল ২০-২০০০০ হার্ৎজ কম্পাঙ্কের (ফ্রিকোয়েন্সি)  শব্দই শুনতে সক্ষম। এখন ভেবে দেখ,যন্ত্রের সাহায্য না নিলে উপরোক্ত সীমার বর্হিভূত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বা কম্পাঙ্কের যথাক্রমে আলো বা শব্দের উপস্থিতি আমাদের বোধের অতীত – এরা নিতান্তই আমাদের কাছে অস্তিত্বহীন।

উপলব্ধি (পারসেপ্শন্) :আলোচনার শুরু থেকেই “উপলব্ধি” (পারসেপ্শন্)  শব্দটা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছি। সময় এসেছে “উপলব্ধি” বস্তুত কি তা বোঝার। উদ্দীপনা (স্টিমুলাস)  আভ্যন্তরীণ (ইন্টারনাল)  হোক কিংবা বাহ্যিক (এক্সটারনাল), তা পর্যবেক্ষকের মধ্যে সর্বদাই কিছু পরিবর্তন ঘটায়।  কোন পর্যবেক্ষকের মধ্যে হওয়া পরিবর্তন (চেঞ্জ)  যখন সেই পর্যবেক্ষক পরিমাপে (মেসার)  সক্ষম হয়, সেই পরিমাপকে (মেসারমেন্ট) বলতে পারি ঐ “পর্যবেক্ষকের উপলব্ধি”। বিষয়টা উদাহরণের মাধ্যমে সহজ করে বোঝাই।  চিন্তা করে দেখ যে, আমরা কোন বস্তু (অবজেক্ট)  দেখতে পাই কিভাবে।  ৩৮০ বা ৪০০ ন্যানোমিটার থেকে ৭০০ বা ৭৮০ ন্যানোমিটার সীমার মধ্যে থাকা যে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (ওয়েভলেঙ্থ)  তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ কোন উৎস (সোর্স)  থেকে বস্তুটির উপর পতিত হয় ও সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখের রেটিনায় পড়ে ও রেটিনার তাৎক্ষণিক অবস্থার (স্টেট)  পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তনটি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষকে উদ্দীপিত করার জন্য যথেষ্ট। ঐ উদ্দীপিত স্নায়ুকোষের প্লাজমা পর্দার স্থির তাড়িতিক বিভব-বৃদ্ধি (ইনক্রিস্ অফ ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক পোটেন্শিয়াল)  লাগোয়া সাইন্যাপ্স-কে (দুটি নিউরোন বা স্নায়ুকোষের সংযোগস্থল নিউরাল কানেক্শন বা স্নায়ু-সংযোগ বা “সাইন্যাপ্স” নামে পরিচিত) সক্রিয় করে তোলে ও সেখানে নিউরোট্রান্সমিটার ক্ষরণ ঘটায় যা সাইন্যাপ্স-টির লাগোয়া আরেকটি স্নায়ুকোষের প্লাজমা পর্দার স্থির তাড়িতিক বিভব-বৃদ্ধি  ঘটায় অর্থাৎ স্নায়ুকোষটিকে উদ্দীপিত করে। কতগুলি নিউরোন বা স্নায়ুকোষের একটি ক্রমে (অর্ডার)  এভাবে উদ্দীপিত হওয়াই উপলব্ধির (ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা বা কিছু স্মরণ করা বা নতুন কিছু ভাবা)  পরিভাষা। মস্তিষ্কের মধ্যে ঐ নির্দিষ্ট কিছু স্নায়ুকোষের উদ্দীপিত হওয়ার অর্থই হলো, মস্তিষ্ক চোখের রেটিনার অবস্থা-পরিবর্তনটি পরিমাপ করতে পেরেছে এবং বস্তুটির আমাদের কাছে দৃশ্যমান হওয়া (যাকে আমরা এক প্রকার “উপলব্ধি” বলতে পারি)  মস্তিষ্কের সেই পরিমাপেরই নামান্তর।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কতগুলি স্নায়ুকোষের উদ্দীপনার ক্রম যদি নিতান্তই ছন্দবদ্ধ (রিদ্মিক) হয়, তবে তা “ব্রেইন ওয়েভ” বা “মস্তিষ্ক তরঙ্গ” নামে পরিচিত।

বিভিন্ন রকমের “ব্রেইন ওয়েভ” বা “মস্তিষ্ক তরঙ্গ”-র প্রাচুর্য্যের ভিত্তিতে মনুষ্য-মস্তিষ্কের প্রধান প্রধান কতগুলি অবস্থা রয়েছে যারা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষ্লেষণের পক্ষে বেশ জটিল। আমি যতটা সম্ভব সঠিকভাবে ও সহজ করে সেগুলি বোঝানোর চেষ্টা করছি –

মনুষ্য-মস্তিষ্কের প্রধান প্রধান অবস্থা (স্টেট্স অফ হিউম্যান ব্রেইন্): মানুষের পর্যবেক্ষণের সাধারণ (কমোন্) অবস্থাসমূহ (স্টেট্) ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় থেকে আগত তথ্যসমূহ প্রধানত মিডব্রেইন এবং মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স ও মিডব্রেইন এর মাঝে অবস্থিত থ্যালামাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

নিরুদ্বেগ জাগ্রত অবস্থা (রিল্যাক্স্ড আওয়েক্ স্টেট) :আমাদের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স কতগুলি লোবে (খন্ড)  বিভক্ত –  ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব, অকিপিটাল লোব ও টেম্পোরাল লোব। জাগ্রত (আওয়েক্) কিন্তু অসতর্ক (নট্ অ্যালার্ট)  বা নিরুদ্বেগ (রিল্যাক্স্ড)  অবস্থায় অকিপিটাল লোব  থেকে এক বিশেষ ধরনের মস্তিষ্ক তরঙ্গ বা ব্রেইন ওয়েভ উৎপন্ন হয় যার নাম “আলফা ওয়েভ” ও কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি)  ৮ – ১২ হার্ৎজ।  চোখ বন্ধ অবস্থায় আলফা ওয়েভ অপেক্ষাকৃত বেশী পরিমাণে উৎপন্ন হয়। সেরিব্রাল কর্টেক্স এর ফ্রন্টাল লোব এর সামনের দিকে অবস্থিত “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটিই (সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ পার্ট)  প্রধানত আমাদের শর্ট টার্ম মেমোরিতে সংগৃহীত তথ্যগুলি ব্যবহার করে যৌক্তিক (লজিকাল্) ও স্বজ্ঞাত (ইন্টিউয়েটিভ) সিদ্ধান্ত নিতে বা কল্পনা করতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের এই অবস্থায় “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি  নিষ্ক্রিয় (ইনার্ট)  থাকে। আচ্ছা তোমার “ল্যাদ্” খেতে ভালো লাগে? ব্যবহারিক বাংলা ভাষায় আমরা যাকে “ল্যাদ্ খাওয়া” বলি, তা মস্তিষ্কের এই অবস্থাকেই নির্দেশ করে।

“শর্ট টার্ম মেমোরি” শব্দটা ইতিমধ্যে ব্যবহার করেছি। “শর্ট টার্ম মেমোরি” কি তা সহজ করে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিই। তুমি এখন যে বাক্যটা পড়ছ তার অর্থ বুঝতে গেলে বাক্যের শেষের দিকের অংশটা পড়ার সময় বাক্যের শুরুটাও তোমাকে মনে রাখতে হবে আর তোমার মস্তিষ্কের শর্ট টার্ম মেমোরি -ই এই কাজটা করে দেয় – অর্থাৎ অল্প সময়ের  (১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড অথবা কখনও ১ মিনিট) জন্য অল্প কিছু তথ্য সে ধরে রাখে। সেরিব্রাল কর্টেক্স এর অকিপিটাল লোব-এ যে ভিসুয়াল কর্টেক্স আছে তার কাছাকাছি রয়েছে একটি নিউরাল লুপ (নিউরাল লুপ হলো কতগুলি স্নায়ুকোষের সমষ্টি যারা কোন একটি নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য একটি সিরিস বা ক্রমে সংযুক্ত থেকে তথ্যকে মস্তিষ্কের এক স্থান থেকে স্থানান্তরে বয়ে নিয়ে যায়) যা দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যের (ভিসুয়াল ডেটা)  শর্ট টার্ম  মেমোরি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও একটি ফোনোলজিকাল নিউরাল লুপ আছে যা ফ্রন্টাল লোব-এ অবস্থিত “ব্রকাস্ এরিয়া”-র সাথে সম্মিলিতভাবে শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যের (অডিও ডেটা)  শর্ট টার্ম  মেমোরি হিসাবে কাজ করে।

সতর্ক জাগ্রত অবস্থা (অ্যালার্ট আওয়েক্ স্টেট) :জাগ্রত অবস্থায় মনুষ্য-মস্তিষ্ক যখনই নিরুদ্বেগ অবস্থা থেকে ক্রমশ সতর্ক হয়, “বিটা ওয়েভ” বা “বিটা তরঙ্গ” [কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) ১২.৫ – ২৮ হার্ৎজ] উৎপন্ন হতে শুরু করে এবং আলফা ওয়েভ উৎপাদন বন্ধ হয়। এই অবস্থায় “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি সক্রিয় হতে শুরু করে।

আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে (নারভাস্ সিস্টেম) একটি স্নায়ুকোষ (নিউরোন)  থেকে আরেকটি স্নায়ুকোষে তথ্য যে সকল রাসায়নিক পদার্থের (কেমিকাল সাব্সট্যান্স)  অণুর (মলিকিউল) মাধ্যমে বাহিত হয় তাদের “নিউরোট্রান্সমিটার” বলে। “এন্ডর্ফিন”, “ডোপামিন”, “অক্সিটোসিন” ও “সেরাটোনিন” – এই চারটি নিউরোট্রান্সমিটার একত্রে “নিউরোট্রান্সমিটার কোয়ার্টেট্” নামে খ্যাত যারা আমাদের উপলব্ধিতে ভালো লাগা বা “ফিল্ গুড্ ফ্যাক্টার”-র জন্ম দেয়। তোমার সামনে এক থালা বিরিয়ানী রাখলে তার পরিপ্রেক্ষিতে তোমার যে সুন্দর উপলব্ধি তার কারণ তোমার মস্তিষ্কে “এন্ডর্ফিন”-র ক্ষরণ। জানি না, তুমি হয়ত প্রেম করেছ। কিন্তু তুমি কি সত্যিই কোনদিন প্রেমে পড়েছ? যদি পড়ে থাকো, তোমার মস্তিষ্ক সেদিন “ডোপামিন”-এ স্নান করেছে। তুমি তোমার উপলব্ধির ঘরে যাকে বিশেষ জায়গা দিয়েছ, তাকে ভাবলে বা তার চোখে চোখ রাখলে তোমার যে উথাল-পাথাল উপলব্ধি তার জন্য দায়ী “অক্সিটোসিন”। ভেবে দেখ, কোন আতঙ্কের সিনেমা দেখলে বা কোন নিষ্ঠুর ঘটনার সাক্ষী হলে, তোমার মস্তিষ্ক কোন্ ধরনের উপলব্ধি বয়ে চলে – এই সময় “সেরাটোনিন” নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ কমে যাওয়ায় উপলব্ধিতে মিশতে থাকে “সারভাইভাল ক্রাইসিস”।

যে বিষয়টায় তুমি তোমার সাফল্য খুব একটা আশা করো না বা যে বিষয়ে তুমি বারবার হোচট্ খাও, সেই বিষয়ে হঠাৎ একটা ছোট্ট সাফল্যে কুড়িয়ে পাওয়া আনন্দ তোমার অজান্তেই বিষয়টিতে তোমার দক্ষতা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। কারণ নিউরোট্রান্সমিটার কোয়ার্টেট্ এর পরিমিত ক্ষরণ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-র সক্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। আবার নিউরোট্রান্সমিটার কোয়ার্টেট্ এর অতিরিক্ত ক্ষরণ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-কে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। সেইজন্য সাফল্য যত বড়ই হোক, অত্যধিক উচ্ছ্বাস মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো নয়।

নিদ্রাবস্থা (স্টেট অফ স্লিপ): নিদ্রাবস্থা  দুটি প্রধান দশায় (ফেজ) বিভক্ত – নন্  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ ও রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ।  একটি নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর পর আসে রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ।  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর শেষে আসে আরেকটি  নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ।  মানুষের ঘুম কতগুলি রাউন্ড বা সাইকল্-এ ঘটে। একটি নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ ও তারপর একটি রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ নিয়ে একটি নব্বই মিনিটের সাইকল্ সম্পূর্ণ হয়।  ঘুমোতে শুরু করার পর যত বেশী সংখ্যক সাইকল্ অতিবাহিত হয়, একটি নব্বই মিনিটের সাইকল্-এ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর সময়সীমা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ – এই দশাটি মোট তিনটি স্টেজ বা উপদশায় বিভক্ত।

প্রথম উপদশা –

টেম্পোরাল লোবের ঠিক নীচে মস্তিষ্কের দুটি “হিপ্পোক্যাম্পাস” নামক অংশ থাকে। এই উপদশায় চোখের পাতা বন্ধ হলেও, মস্তিষ্কের ভিসুয়াল কর্টেক্স-এর কাছে অবস্থিত নিউরাল লুপটি যা দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যের শর্ট টার্ম মেমোরি হিসাবে কাজ করে, হিপ্পোক্যাম্পাসে লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত ভিসুয়াল ডেটা পাঠাতে শুরু করে ও তাই নিউরাল লুপটির নিউরোন বা স্নায়ুকোষগুলি সক্রিয় থাকায় তা প্রায়শই  চোখের টনিক পেশীকে (টনিক মাসল্)  কম হারে কিন্তু অনেক সময় ধরে  উদ্দীপিত (স্টিমুলেট্)  করে যার ফলে চোখের এক ধীর গতির চলন (মুভমেন্ট)  লক্ষ করা যায়। সতর্ক জাগ্রত অবস্থা থেকে  নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর এই প্রথম উপদশায় উপনীত হলে, শর্ট টার্ম মেমোরি  থেকে আসা ভিসুয়াল ডেটা গ্রহণ করে হিপ্পোক্যাম্পাস উদ্দীপিত হয় ও উচ্চতর (হায়ার)  কম্পাঙ্কের থিটা তরঙ্গ বা হিপ্পোক্যাম্পাল থিটা তরঙ্গ নির্গত করতে শুরু করে যা মস্তিষ্কে মানুষটির নিজের বর্তমান অবস্থান (কারেন্ট স্পেশিয়াল লোকেশন)  এর ধারণা রাখতে সাহায্য করে।

মানুষের মিডব্রেইন এর মধ্যরেখার কাছাকাছি কতগুলি নিউরোন বা স্নায়ুকোষের একটি দল দেখা যায় যার নাম “ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া”। এই দলের ডোপামিনারজিক নিউরোন বা ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদনকারী স্নুকোষগুলি নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে সক্রিয় হয়ে উঠলে তবে আমাদের ঘুম ভাঙে। নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর প্রথম উপদশায় ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া-র ডোপামিনারজিক নিউরোনগুলি সাধারণত অল্প হলেও সক্রিয় থাকে ও তাই নিদ্রার এই উপদশা থেকে জেগে যাওয়া ব্যক্তি অনেক সময় মনে করেন যে তিনি জেগেই ছিলেন।

মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্স, সেরিবেলাম, বেসাল গ্যাংলিয়া, পেডাঙ্কিলোপন্টাইন নিউক্লিয়াস (স্নায়ুবিজ্ঞানে নিউক্লিয়াস হলো কতগুলি স্নায়ুকোষের এমন জটলা যেখানে সবকটি স্নায়ুকোষ প্রায় একই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়), রেড নিউক্লিয়াস ও সাবকর্টিকাল মোটর নিউক্লিয়াসগুলি  বিভিন্ন মোটর নিউরোনের সাহায্যে আমাদের স্কেলেটাল পেশীগুলিকে ও গ্রন্থিগুলিকে (গ্ল্যান্ড)  প্রয়োজনমত উদ্দীপিত করে।  পেশীর এই উদ্দীপনা প্রধানত দু রকমের – মাসল্ টোন ও মাসল্ টেন্শন।  কোন কিছু ওঠানো, নামানো, ঠেলা বা টানার জন্য পেশীর স্থিতিস্থাপকতা (ফ্লেক্সিবিলিটি)  অপেক্ষা শক্তি (স্ট্রেংথ্)  অনেক বেশী প্রয়োজন।  তখন মাসল্ টেন্শন বেশী প্রয়োজনীয়।  কিন্তু স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানো বা হাঁটার সময় সম্পূর্ণ দেহের ভারসাম্য (ব্যালান্স)  রক্ষার জন্য কিংবা শোয়ার সময় মস্তিষ্কের শক্তিব্যয় কমানোর জন্য, হাত ও পায়ের পেশীতে শক্তি কমিয়ে স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো হয় অর্থাৎ পেশীতে মাসল্ টোন প্রকৃতির উদ্দীপনা পাঠানো হয়ে থাকে এবং প্রধানত মস্তিষ্কের সেরিবেলাম এই উদ্দীপনা পাঠায়। এছাড়াও সেরিবেলাম নাসারন্ধ্র থেকে ল্যারিংসের ভোকাল ফোল্ড এর আগে পর্যন্ত শ্বাস বায়ুর চলাচলের পথে (আপার এয়ারওয়ে)  যতগুলি পেশী আছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে । ঘুমের শুরুতে অর্থাৎ প্রথম নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর প্রথম উপদশা যখন শুরু হয়, সেরিবেলাম শ্বাসকার্যে (রেস্পিরেশন)  নিজের শক্তিব্যয় কমানোর জন্য, আপার এয়ারওয়ে এর পেশীগুলিতে মাসল্ টোন কমাতে শুরু করে (আপার এয়ারওয়ে এর পেশীগুলিতে কম মাসল্ টোন থাকার জন্যই নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ সকল মানুষেরই শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী হয় যাকে আমরা “নাক ডাকা” বলি) ও তারফলে সেরিবেলাম থেকে হাত বা পায়ের কোন কোন পেশীতে অনেক সময় মুহূর্তের জন্য স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশী মাসল্ টোন প্রেরিত হয় [কারণ, মানুষের জাগ্রত অবস্থায়, সেরিবেলাম সাধারণত প্রতি একক সময়ে ধ্রুবক (কন্সট্যান্ট)  পরিমাণ শক্তিব্যয় করতে অভ্যস্ত]।  তখন আমরা পেশীটিতে এক ঝাঁকুনি অনুভব করি বা আমাদের মধ্যে “পতন” বা “পড়ে যাওয়া”-র অনুভূতি জন্ম নেয় যার প্রভাবে আমরা পুনরায় জাগ্রত অবস্থায় ফিরে যাই। এই অনুভূতি “হিপ্নিক জার্ক” নামে খ্যাত।

দ্বিতীয় উপদশা –

এই উপদশায় চোখের কোনরূপ চলন দেখা যায় না। এই সময়, থ্যালামিক রেটিকিউলার নিউক্লিয়াস এবং অন্যান্য থ্যালামিক নিক্লিয়াসগুলির পারস্পরিক ক্রিয়ায় মাঝে মাঝে প্রায় ১০ – ১২ হার্ৎজ কম্পাঙ্কের স্বল্পস্থায়ী (অন্তত ০.৫ সেকেন্ড) এক তরঙ্গ উৎপন্ন হয় যাকে “স্লিপ স্পিন্ডিল্স” বা “সিগ্মা ওয়েভ্স” নামে ডাকা হয়।

দ্বিতীয় উপদশায় স্লিপ স্পিন্ডিল্স ছাড়াও প্রতি ১ – ১.৭ মিনিটে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (ওয়েভলেঙ্থ) “ডেল্টা তরঙ্গ” (কম্পাঙ্ক ১.৬ – ৪.০ হার্ৎজ) দেখা যায় যা এক সেকেন্ড মত স্থায়ী হয়। এই ডেল্টা তরঙ্গগুলির এক একটিকে “কে-কম্প্লেক্স” বলা হয়।

নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-র এই দ্বিতীয় উপদশায় প্রায়ই কে-কম্প্লেক্স তরঙ্গ উৎপন্ন হওয়ার ঠিক পরেই স্লিপ স্পিন্ডিল্স বা সিগ্মা ওয়েভ্স আবির্ভূত হয়।  কে-কম্প্লেক্স তরঙ্গের মাধ্যমে মস্তিষ্কের শর্ট টার্ম মেমোরিতে সঞ্চিত প্রধানত শব্দ ও ভাষা সংক্রান্ত তথ্যগুলি হিপ্পোক্যাম্পাস-এ আসে।  হিপ্পোক্যাম্পাস সংগ্রহীত শব্দ, ভাষা ও দৃষ্টি সংক্রান্ত তথ্যগুলির মধ্যে কোনগুলি প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি (পদ্ধতিগত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি) ও কোনগুলি ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি (ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি)-র জন্য উপযুক্ত তা নির্বাচন (সিলেক্ট)  করে, নির্বাচিত কিছু ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি -র জন্য উপযুক্ত তথ্যকে এনকোড্ (সংকেতাক্ষরে লিখন)  করে এবং নির্বাচিত সকল প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি -র জন্য উপযুক্ত তথ্যকে কনসলিডেট (সমন্বয়সাধন)  করে।  তারপর এনকোডেড্ হওয়া  ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলি স্লিপ স্পিন্ডিল্স তরঙ্গ বা সিগ্মা ওয়েভ্স এর মাধ্যমে টেম্পারাল কর্টেক্স-এ আসে আর এনকোডেড্ না হওয়া তথ্যগুলি সিগ্মা ওয়েভ্স-র রূপেই এনটোরাইনাল ও পেরিরাইনাল কর্টেক্সে আসে।  এছাড়াও প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি -র জন্য উপযুক্ত কনসলিডেটেড্ সকল তথ্যসমূহ সিগ্মা ওয়েভ্স এর মাধ্যমেই হিপ্পোক্যাম্পাস থেকে সেরিবেলাম, পুটামেন, কডেট নিউক্লিয়াস ও মোটর কর্টেক্সে আসে।

এই প্রসঙ্গে ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি ও প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি কি তা বলে নিই। তুমি তিন-চার বছর বা তারও আগে যে সিনেমাটি দেখেছ তার বিষয়বস্তু অথবা কোথাও বেড়াতে গিয়ে তুমি কি কি করেছ বা কি কি দেখেছ তা স্মরণ করে গরগর করে বলে দিতে পারো এই ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র বদান্যতায়। আবার কিছু বিষয় আছে যা স্মরণ করতে হয় না বা স্মরণে রাখতে হয় না, স্মরণে রয়ে যায়। আমি সাইকেল চালানো শিখে তিন বছর অল্প-বিস্তর সাইকেল চালিয়েছিলাম। গত এগারো বছর আমি সাইকেল ছুঁইনি পর্যন্ত কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী যে সাইকেল চালাতে গিয়ে আমি মোটেই ভারসাম্য হারাবো না কারণ সাইকেল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ (কিংবা কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা)  মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই তার প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি (পদ্ধতিগত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি)-তে জমা করে রাখে। তবে এমন অনেক তথ্য আছে যারা ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত হলেও সেই তথ্যের দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশী ব্যবহারের জন্য মস্তিষ্ককে প্রায়ই তথ্যগুলিকে চট্-জল্দি স্মরণ করতে হয় কিংবা কিছু বিষয়ে আমাদের পছন্দ বা বিশেষ অনুভূতির কারণে মস্তিষ্ক সেই সংক্রান্ত তথ্যগুলি নিজ স্মৃতিতে চিরস্থায়ী করতে চায়। এই সকল ক্ষেত্রে প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-ই ভরসা। প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি অভ্যাস বা কোন কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। ইংরাজীতে “প্র্যাক্টিস মেক্স আ ম্যান্ পারফেক্ট” কথাটি পরম সত্য কারণ প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-তে সঞ্চিত নির্দিষ্ট কোন কাজ করার পূর্বাভিজ্ঞতা আমাদের অজান্তেই কাজটিকে আরও নিখুঁতভাবে ও দক্ষতার সাথে করতে সাহায্য করে।

আমরা অনেকেই অনেক সময় ভেবে থাকি যে আমাদের অনেক রকম অধীত বিদ্যা বা অর্জন করা দক্ষতা প্রয়োগের যথাযথ সুযোগ আমরা পেলাম না। আমরা আমাদের বর্তমান পেশা বা কর্মজীবনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয়ত কখনও কখনও ভাবি যে বোধ হয় অত কিছু না জানলে বা শিখলেও চলত।  এই প্রসঙ্গে আমার মা বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় – “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা” কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব তা বোঝাচ্ছি। ভাবলে অবাক হবে যে, আমাদের স্মরণ করা তথ্যসমূহ যেমন আমাদের মস্তিষ্কে এনকোড্ করে রাখা স্মৃতির ডিকোডেড্ রূপ তেমনই আমরা নতুন যা কিছু ভাবি তা হলো ঐ ডিকোডেড্ তথ্যসমূহের এনক্রিপ্টেড্ রূপ। অর্থাৎ আমরা যে কাজই করি না কেন বা আমরা বর্তমানে যে পেশার সাথেই যুক্ত থাকি না কেন, মস্তিষ্ক সেই ছোট্টবেলা থেকে শিখে আসা সকল বিদ্যা বা  অর্জিত দক্ষতাকে আমাদের অজান্তেই কাজে লাগিয়ে দেয়।

তৃতীয় উপদশা –

এই উপদশায় এনটোরাইনাল ও পেরিরাইনাল কর্টেক্সে আসা ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলি সংকেতাক্ষরে লিখিত (এনকোডেড্)  হয়।  এছাড়াও প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত কনসলিডেটেড তথ্যসমূহ সেরিবেলাম, পুটামেন, কডেট নিউক্লিয়াস ও মোটর কর্টেক্সে এনকোডেড্ হয়।  এই উপদশায় ০.৫ – ২ হার্ৎজ কম্পাঙ্কের ও ৭৫ মাইক্রোভোল্ট বিস্তারের (অ্যাম্প্লিচিউড)  ডেল্টা তরঙ্গ উৎপন্ন হয়।  খুব কম কম্পাঙ্কের হওয়ায় এই ডেল্টা তরঙ্গকে সাধারণত “স্লো ওয়েভ” এবং এই উপদশাকে “স্লো ওয়েভ স্লিপ” বা “ধীর তরঙ্গের ঘুম” বলা হয়।  এই  “স্লো ওয়েভ”-ই তৃতীয় উপদশায় ঘটে চলা সকল এনকোডিং প্রক্রিয়ার (প্রোসেস্)  হোতা।

এই তৃতীয় উপদশায় মানুষ কখনও কখনও স্বপ্ন দেখে, তবে সে স্বপ্ন হয় অসংলগ্ন ও অপরিষ্কার যা ঘুম থেকে জেগে আর মনে থাকে না। এই উপদশায় তথ্যসমূহের যে এনকোডিং প্রক্রিয়া চলে তা-ই আমাদের কাছে কখনও কখনও অসংলগ্ন ও অপরিষ্কার স্বপ্ন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ

সেরিবেলাম নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ সাধারণত  হাত-পায়ের স্কেলেটাল পেশীগুলিতে স্বাভাবিক মাসল্ টোন [হাত-পায়ের স্কেলেটাল পেশীগুলিতে স্বাভাবিক মাসল্ টোন থাকার জন্যই নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ অনেকের ঘুমিয়ে চলার (স্লিপ্-ওয়াক্) অভ্যাস থাকে] ও আপার এয়ারওয়ে-র পেশীগুলিতে অনেক কম মাসল্ টোন বজায় রাখে।  এরপর ঘুমের রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ শুরু হলে, সেরিবেলাম হাত-পায়ের স্কেলেটাল পেশীগুলিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম [সেইজন্যই রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ হাত-পা অসাড় (প্যারালাইস্ড)  থাকে] এবং আপার এয়ারওয়ে-র পেশীগুলিতে স্বাভাবিক মাসল্ টোন বজায় রাখে [ফলে রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ শয্যা সঙ্গী(নি)-র “নাক ডাকা” থেকে নিস্তার পাওয়া যায়]।

এই দশায় সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের শক্তি-ব্যায়ের হার জাগ্রত অবস্থা বা নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ অপেক্ষা বেশী।  মস্তিষ্কের পিছনের দিকে যে অংশটি স্পাইনাল কর্ডের সাথে অবিচ্ছিন্ন তা “ব্রেইন-স্টেম” নামে পরিচিত (এটি মেডুলা অবলংগাটা, পন্স ও মিডব্রেইন – এই তিনটি অংশ নিয়ে তৈরি হয়)।  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ পন্স অংশটি থেকে পন্টো-জেনিকিউলো-অকিপিটাল নামক এক বিশেষ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে তা থ্যালামাস-র মধ্যে অবস্থিত ল্যাটারাল জেনিকিউলেট নিউক্লিয়াস এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অকিপিটাল লোবের প্রাইমারী ভিসুয়াল কর্টেক্স পর্যন্ত যায় – ফলে প্রাইমারী ভিসুয়াল কর্টেক্স সক্রিয় হয়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও চোখের টনিক পেশীকে দ্রুত হারে উত্তেজিত করে।  তখন চোখের পাতা বন্ধ অবস্থাতেই চোখের টনিক পেশী মধ্যস্থিত ফাস্ট ট্যুইচ্ মাসল্ ফাইবার দ্বারা চোখ বেশ দ্রুত চালিত হয়।  চোখের এই দ্রুত চলনের উপর ভিত্তি করেই ঘুমের এই দশার নাম দেওয়া হয়েছে – “রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ”।

ঘুমের এই দশাতেই মানুষ সবচেয়ে বেশী স্বপ্ন দেখে।  এনটোরাইনাল ও পেরিরাইনাল কর্টেক্সে এনকোডেড্ হওয়া ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলি এই দশাতেই টেম্পোরাল কর্টেক্সে কনসলিডেটেড্ হয়ে সঞ্চিত (স্টোর্ড)  হয়।  শুধু তাই নয়; সেরিবেলাম, পুটামেন, কডেট নিউক্লিয়াস ও মোটর কর্টেক্সে এনকোডেড্ হওয়ার পর প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলির সঞ্চয়ের (স্টোরিং) কাজ এই দশাতেই চলতে থাকে। তথ্য সঞ্চয়ের এই প্রক্রিয়াসমূহই কখনও কখনও  স্বপ্ন রূপে ধরা দেয়।  এই দশায় পরিষ্কার স্বপ্ন দেখা যায় এবং ঘুম থেকে জাগার পরেও সেই স্বপ্ন মনে থাকে, তবে এই স্বপ্নে ছবি (ইমেজ্) বা আবেগ (ইমোশন্) বা ঘটনাগুলি বাস্তব ঘটনাগুলির মত কারণ-ফলাফল সম্পর্কের (ক্যসালিটি)  ভিত্তিতে হয় না। উদাহরণস্বরূপ – ধর তুমি একটা একশো পাতার গল্প পড়ছ।  তুমি গল্পটা এক নম্বর থেকে একশো নম্বর পাতা অবধি পরপর না পড়ে; প্রথমেই দশ নম্বর পাতা থেকে এক নম্বর পাতা পর্যন্ত পরপর পড়লে, তারপর এক নম্বর পাতা থেকে ত্রিশ নম্বর পাতা পর্যন্ত পরপর পড়লে এবং তারপর ত্রিশ নম্বর পাতা থেকে আবার ক্রমান্বয়ে কুড়ি নম্বর পাতা পর্যন্ত পিছিয়ে এলে – এভাবে পুরো একশো পাতা পড়লে ভেবে দেখ যে গল্পটা সম্পর্কে তোমার কী ধারণা হবে।  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ স্বপ্নের অভিজ্ঞতা অনেকটা সেরকমই।  এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাগ্রত অবস্থায় পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা, পূর্বোল্লিখিত গল্পটা এক নম্বর থেকে একশো নম্বর পাতা অবধি পরপর পড়ে যে ধারণা হয় তার অনুরূপ।  আর গল্পটার সবকটা পাতা না পড়ে মাঝখান থেকে কয়েকটা পাতা পড়লে তোমার পড়া বিষয়টা বেশীদিন মনেও থাকবে না।  এক্ষেত্রে গল্পটা সম্বন্ধে ধারণা, নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট দশার তৃতীয় উপদশায় দেখা স্বপ্নের অভিজ্ঞতার মত।

ধ্যানমগ্ন অবস্থা (মেডিটেটিভ্ স্টেট): ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্কের সামনের ভাগে ও মধ্যভাগে কর্টিকাল থিটা তরঙ্গ [এই তরঙ্গ হলো সেরিব্রাল কর্টেক্স এর এক বা একাধিক লোব থেকে উৎপন্ন হওয়া নিম্নতর (লোয়ার) কম্পাঙ্কের থিটা তরঙ্গ] এবং মস্তিষ্কের পশ্চাৎভাগে আলফা তরঙ্গের প্রাচুর্য্য থাকে।

দীর্ঘদিন ব্যাপী স্বাত্ত্বিক জীবনে (স্পিরিচুয়াল প্র্যাক্টিস) ও ধ্যানে অভ্যস্ত কোন ব্যক্তি এতখানই গভীর ধ্যানে মগ্ন হতে সক্ষম হন যে তিনি ধ্যান মগ্ন অবস্থায় সকল ভাবনা বা চিন্তা থেকে বিরত হতে পারেন এবং এমতাবস্থায় কোন চেষ্টা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন ধরনের ধারণা (আইডিয়া), আবেগ (ইমোশন্) বা সংবেদন (সেনসেশন্) তাঁর মস্তিষ্কে একে একে প্রকট হয় ও বিলীন হয় – এই প্রকার উপলব্ধি, সচরাচর ব্যবহার হয় না এমন স্নায়ুকোষ সমূহের ছন্দবদ্ধভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠার ফল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top