Scientific Bangladesh

কালো কালিতে সাদামাটা কথা

মোঃ আরাফাত রহমান (রানা)

কিছুদিন যাবত বিক্ষিপ্ত মনে কি যেন ভাবতে থাকি। বুঝে ঊঠতে পারি না। এ লেখার সময়ও বুঝতে পারছি না মনে হয়। কিন্তু কেন জানি সব কিছুর উপর খুব রাগ হচ্ছে।দৈনিন্দন জীবনে সব কিছুর দাম যেন নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। বিদ্যুত বিল কেমন যেন ভূতুড়ে ভাবে আসে ইদানীং। এই মাসে দেখি ৫০০ টাকা পরের মাসে দেখি ১৫০০ টাকা। কিভাবে মেজাজ ঠিক থাকে বলেন?এতো গেল শুধু বিদ্যুত বিলের কথা, এর সাথে আছে খাবারের জিনিসের দাম, কাপড়ের দাম। বছর শেষে যখন দেখি মাত্র ৭০০-৮০০টাকা বেতন বেড়েছে, তখন আর ভয় করে বলতে ইচ্ছা করে না যে বেতন নামক অসংগতির নিয়ামকের কিছু উন্নতির খবর।

ইদানীং খবরের কাগজে বিশ্যবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলা হচ্ছে। শুনতে ভালই লাগে যখন দেখি অনেক বড় মাপের মানুষজন এই অবহেলিত মানুষ্যগোষ্ঠির জন্য কথা বলছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তখন হয়, যখন দেখি কেউ কেউ ইচ্ছা করেই , ভালভাবে না জেনে অবিবেচকের মত কথা বলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খুবই নিচু মনের পরিচয় দিয়ে কথা গুলো বলেন। সব সময় বলা হয় পাব্লিক বিশ্যবিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের ক্লাস না নিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। আমিও ব্যাপারটি খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করেছি। ব্যাপারটি আসলেই যদি ঘটে থাকে তাহলে খুবই দুঃখজনক।প্রায় দুই বছর আগে (২৯শে জুন,২০১০ইং) দৈনিক প্রথম আলোতে গোলাম মুরশিদ স্যারের একটি কলাম পড়েছিলাম। “শিক্ষকদের একাল ও সেকাল” নামক নিবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে বলেছেন… “শিক্ষকতা এমনই একটি পেশা ,যার সাথে জড়িয়ে আছে খানিকটা আত্নত্যাগ,জ্ঞানের সাধনা এবং ছাত্রদের শেখানোর আগ্রহ। Plain living high thinking.”। আসলেইতো এমনটি হওয়া উচিত। কেন হচ্ছে না আমরা কি ভেবে দেখেছি একবারও? শুধুই কি শিক্ষকদের দোষ? অন্য কারো কি প্রভাব নেই শিক্ষকদের একালের জীবনের? বললে অনেক প্রশ্ন এসে দাড়ায় সামনে। প্রশ্ন করে আর লাভ নেই, যখন দেখি আর কোন উত্তর খুজে পাই না।তবুও উত্তর খোজার প্রয়াস থেকে আমি আমার জীবনের অবস্থাটি অবতারণা কতে চাই। যদিও ব্যাপারগুলো বিক্ষিপ্ত বলে মনে হবে তারপরও কিছু মনে হয় খুজে পাওয়া যাবে।

২০০৭ ইং সালে, আমি যখন সদ্য  ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বের হলাম, আমার পিতার সমতুল্য শিক্ষকদের জীবনযাপন প্রণালী দেখে অনুপ্রানিত হলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম শিক্ষকতা হবে আমার জন্য সবচেয়ে ভাল পেশা। পাস করার পর পরই যখন বাহিরে পড়ার জন্য বৃত্তি পেয়ে গেলাম, মনটা যেমন খুব খুশিতে দুলে উঠলো, তেমনি কেমন যেন শিক্ষক না হতে পারার ভয়ে মনটা ভারীও হয়ে গেল।যাইহোক বিদেশ গেলাম । ডিগ্রী শেষ করলাম। আনন্দের সাথে দেশে ফিরতে চাইলাম। কিন্তু বিপত্তি বাধালো আমার সুপারভাইজার। আমাকে তার অফিসে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন “তুমি দেশে গিয়ে কি করবে? তোমাদের দেশে তো উচ্চশিক্ষিত মানুষের কোন কাজ নেই?!!!” আমি বললাম যে আমি শিক্ষক হব……তিনি উত্তর দি্লেন “তোমাদের না আছে ভাল কোন গবেষনাগার, না আছে কোন ভাল কোম্পানি, তোমার দেশের শিক্ষকরাতো খুবই গরীব, আমার মনে হয় সর্বোচ্চ ৫০০ ডলার বেতন পান, ওটা তো আমি একমাসে পানসালাতে গিয়েই খরচ করি। বরং এখানে থাক, চাকুরি করো, ভাল থাকবা……”। তখন আমি নিজে বড় যুক্তিবিদ হয়ে গেলাম। প্রফেসরকে বুঝালাম, দেখো আমদের দেশে ১ কেজি চালের দাম মাত্র ৪০ টাকা, তোমাদের এখানে ১৪০টাকা। তাহলে ভাবো আমাদের ৫০০ ডলারের দামকত এখানে্র সাপেক্ষে? অনেক টাকা…!!!!

 

ফিরলাম দেশে। যোগদিলাম নিজের ক্যাম্পাসে। কিন্তু বিপত্তি বাধলো দেখি আমার প্রফেসরের কথা ঠিক হতে চলছে। সারাদিনে ক্লাস নেওয়ার পরে যখন ফুরসত পাই যে এখন রিসার্চ করবো, তখন দেখি কোন গবেষনাগার নাই, যদিও আছে তাতে কোন ইন্সস্ট্রুমেন্ট নাই,তাও যদি থাকে তা আর চলে না। অকেজ়ো হয়ে পড়ে আছে।যদিও চলে ,বিদ্যুত নামক আজব বস্তুটি নাই। নিজের অফিসে ঢুকে যখন কোন কিছু করতে বসলাম, আবারো ঐ বিদ্যুত নামক বস্তুটী নাই। কম্পিঊটারটা আর চলে না।UPS  নামক বস্তূটি খুব চিতকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়,কেন তাকে বন্ধ করি না?UPS এর off বাটনের সাথে সাথে আমার গবেষনা ও বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে কি করা যায়? কিছু একটা তো করা দরকার। সময়তো কাটানো দরকার। তখনই সামনে চলে আসে প্রাইভেট বিশ্যবিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার হাতছানি। কেঊ যদি প্রশ্ন করে আ্মাকে , কেন আপনি ক্লাস নেওয়ার কথা ভাবলেন? আপনি তো সৃজনশীল কাজ করে ও তো সময় কাটাতে পারতেন? ভাল কথা। কতক্ষন করবেন আপনি? তারপরে তো আপনাকে বাসাতে যেতে হবে। বাজার করতে হবে,ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দিতে হবে, বৃদ্ধ বাবা মার ঔষুধ কিনতে হবে, বাসা ভাড়া দিতে হবে, কাপড় ধোয়ার জন্য সাবান কিনতে হবে কত কিছু। তারঊপর আছে বাসা ভাড়া দিতে হবে। এবার বলুনতো আমার সৃজনশীল কাজ সবসময় করলে চলবে ? বেতন তো বাড়ে নাই ১০০০টাকা, খরচ আমার বেড়েছে ৫০০০ টাকা বছর শেষে।

তখন আর কোন কিছুই করার না থাকাই,  চললাম প্রাইভেট বিশ্যবিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে। এতে নিজের আর্থিক দৈন্যতাটাও ঘুচলো আবার নিজের মাথাটাও একটি ভাল কাজে ব্যয় হলো।নাই মামার চাইতে কানা মামা ভাল আর কি !!!

দৈন্যতাটা প্রকাশ করার মানে এই নয় যে, শিক্ষকদের অনেক অনেক টাকা দেওয়া হোক। তাদেরকে সুষ্ঠ পরিবেশ দেওয়া হোক।বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরাই তো বিদেশে গিয়ে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে ভাল ভাল চাকুরী করছেন। কেন তারা দেশে কাজ করতে পারবেন না? তাদের মেধাতো আমদেরই আগে অধিকার । তাদেরকে দেশে আসার সুযোগ করে দিতে হবে।

পরিশেষে, একটি কথা বলে শেষ করতে চাই। শিক্ষকরা সমাজ ,জাতি বা দেশের বাহিরের মানুষ না। শিক্ষকরা কোন সময়ই বলতে চান না , দেশের আর দশজন মানুষ যখন কম শিক্ষা নিয়ে ভাল আছেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন পারবেন না? প্রত্যেকজন শিক্ষকই প্রায় তার ব্যাচের সর্বোচ্চ মেধার প্রতিফলন ঘটিয়েই তারা শিক্ষকতা নামক মহান পেশাতে এসেছেন। তারা বাহিরে থাকলে অনেক অনেক ভাল থাকতেন। বিশেষ করে আর্থিক ভাবে। তাদের প্রতি কেন এই অবহেলা? শুধু  শিক্ষকদের কথা বলবো না , দেশের সমস্ত বিজ্ঞানী,শিক্ষিত মানুষ যারা গবেষণা করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারবে তাদেরকে সহ সকলকে  সুযোগ দেওয়া হোক গবেষনার। তারাও পারবে এই বাংলাদেশকে সমসাময়িক উন্নত দেশে পরিনিত করতে… ……!!!

কি নেই এই দেশে ? যা অন্য উন্নত দেশে আছে? একবার ভেবে দেখুন সব আছে আমাদের।শুধু আমাদেরকে ব্যবহার করতে শিখতে হবে……

 

লেখকঃ শিক্ষক,যন্ত্রকৌশল বিভাগ, চুয়েট।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top