Scientific Bangladesh

বাংলাদেশে মেধার অপচয়: মা বাবা আর ভর্তি প্রক্রিয়ার ভূমিকা আর আমাদের করনীয় ।

ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক মেধাবী ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, চাকরিজীবী দেশ ছেড়ে চলে যায় উন্নত দেশে পড়াশোনা করতে বা চাকরী করতে । মেধার এই পাচার নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা, হওয়াই উচিত। মেধা পাচার বন্ধ করার জন্য আমাদের কার্যকর ব্যবস্থাও নেওয়াও উচিত।সাথে আমাদের আরেকটা বিষয় নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত । কিন্তু সে উদ্বেগ দেখা যায় না, সেটা নিয়ে কথাও শোনা যায় না। কারণ সেটা মনে হয় আমাদের নজরে পড়েনি এখনো। সেটা হচ্ছে মেধার অপচয়। আমরা মেধার পাচার নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হলেও মেধার অপচয় সম্পর্কে একবারেই অসচেতন ।তাই এই নিয়ে কোথায় কোন আলোচনা নেই, উদ্বেগের প্রকাশও নেই।

কিছু দিন আগে ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় শাখার সভাপতি হাসান ইকবাল সজীব হতাশার কারণে হয় আত্মহত্যা করেছেন, না হয় অন্যমনস্ক অবস্থায় রেল লাইন ধরে হাটতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন । এসএসসিতে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করা এই মেধাবী ছাত্রের অকাল মৃত্যু কি মেধার অপচয় নয়? এই অপচয়টা ঘটল কিভাবে, হতাশাটা আসল কিভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। সজিবের ইচ্ছা ছিল চারুকলায় পড়ার। প্রথম বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। পরের বার চারুকলায় পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে মা বাবার আপত্তির কারণে সে চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে নি। কোন কোন মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার কারণে সে চারুকলায় ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে পারে নি।কারণ যাই হোক, যখন সে নিশ্চিত হয়েছে তার পছন্দের সাবজেক্ট পড়া আর তার হবে না তখনই মেধাবী ছাত্রের পরিসংখ্যান পড়া কঠিন হয়ে গেছে এবং পর পর দুইবার দ্বিতীয় বর্ষ সমাপনী পরীক্ষায় ফেল করেছে। ফলে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মাদকাসক্তি এবং চুরির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে সভাপতির পদ হারিয়েছে, শেষমেশ হারিয়েছে বা হরণ করেছে নিজের জীবন । এরকম নিজের পছন্দের বিষয় পড়তে না দেওয়ার কারণে বা পড়তে না পারার কারণে দেশে যে কত মেধাবী অকালে হারিয়ে যাচ্ছে বা জীবন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে তার খেয়াল কে রাখে? মনে পড়ে, আমার বাবার বন্ধুর এক মেধাবী ছেলেও এভাবে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। বাবার এক রোখা বন্ধু, যিনি এক রোখা প্রধান শিক্ষক বলে এলাকার শিক্ষিত মহলে পরিচিত, তার মেধাবী ছেলে কে ডাক্তার বানিয়েই ছাড়বেন। কিন্তু ছেলের ডাক্তারি পছন্দ না। তাই বাবার চাপাচাপিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেও পাশ দেওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। হতাশায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।পিতা পুত্রের সম্পর্কও নষ্ট হয়। শেষে একদিন শহরের আবাসিক হোটেলে পাওয়া গেল সেই মেধাবী পুত্রের লাশ। পুত্র হারিয়ে হয়ত পিতা নিজের কিছু ভুল বোঝতে পারলেন, যিনি আগে শুক্রবারের জুমার নামায পড়তেন না, এখন তিনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। মা বাবার এরকম চাপিয়ে দেওয়া বিষয় পড়তে গিয়ে কত মেধাবী যে হারিয়ে যাচ্ছে তার কি কোন হিসাব আছে আমাদের কাছে। এই নিয়ে কি উদ্বেগ আছে আমাদের মাঝে , আছে এই এই অপচয় বন্ধের কোন প্রচেষ্টা?

সব সময় যে এই রকম ক্ষেত্রে মেধাবী অকালে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় তা হয়ত না, কিন্তু তাদের পক্ষে তাদের মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার করা সম্ভব হয় না, পেশাটাকে তারা উপভোগ করে না, পেশাগত জীবনটা হয় কারাগারের মত। তাই এরা সপ্তাহের শুরুতে অফিসে যায় অনিচ্ছুক পেঙ্গুইনের মত গড়িয়ে গড়িয়ে আর সপ্তাহ শেষে ফেরে আনন্দ চিত্তে, নাচতে। এরা যেমন অফিসের কাজটাকে উপভোগ করে না, তেমনি অফিস, সাথে দেশে এদের মেধা থেকে সর্বোত্তম সেবা পায় না।

মেধার অপচয় ঘটে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব মেধা পাচার থেকে কম না।

আমার এক বন্ধু , কিছু দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। মেধাবী এই বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে পারতেন, ভর্তি পরীক্ষায় সে যোগ্যতা অর্জন করেছিল। কিন্তু মামাদের ইচ্ছা ভাগনে ইঞ্জিনিয়ার হোক। তাই বুয়েটে মেকানিক্যাল পড়তে গেল। কারণ ওখানে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে সে পারবে না। আমার সেই বন্ধু একদিনের জন্যও মেকানিক্যালের কোন জব করেনি। পড়তে পড়তেই কম্পিউটার সায়েন্সের কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে, অনলাইন পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়েছে এবং নিজেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছে । নিজেকে সফটওয়্যার ডেভেলপার কোম্পানির কর্ণধারে উন্নীত করেছে। আরেক জনের ঘটনা, ছেলের ইচ্ছা ফিজিক্স পড়ার কেননা ভবিষ্যতে এস্ট্রোফিজিক্স এ গবেষণা করবেন। কিন্তু মা বাবার স্বপ্ন ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। মা বাবার চাপে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী হাতে নিয়ে সেটা মা বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছেলে চললেন নতুন করে ফিজিক্স পড়তে বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে । পছন্দের বাইরে পড়তে গিয়ে ছেলের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়েছে, মা বাবার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ছেলে শেষ পর্যন্ত এস্টোফিজিক্স এ পিএইচডি শুরু করেছেন কিন্তু শেষ করার মত মানসিকতা অটুট আছে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে । পছন্দ না হলে, ভাল না লাগলে কোন খাবার যেমন বেশী বা ঘন ঘন খাওয়া যায় না, তেমনি ভাল না লাগলে কোন বিষয় বেশীক্ষণ বা বেশী দিন দিন পড়া যায় না, সেই বিষয়ে ভাল করা যায় না, পেশায় উন্নতি করা যায় না। যদি ভাল না লাগা সত্যেও পড়তে হয়, তাতে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এ ব্যাপারে লেখকের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বায়োলজি পড়তে তার ভাল লাগে না। তাই সারা বছর একটু একটু করে পড়তে পারলেও পরীক্ষার আগে এক সাথে পুরু সিলেবাস শেষ করতে পারতেন না। তাই বায়োলজিতে কখনো অন্য বিষয়ের মত ভাল করতে পারেন নি।এস এস শি , এইচ এস শি আর ভর্তি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল, যথেষ্ট মেধা নিয়ে ভর্তি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাঝারী ধরনের ফলাফল নিয়ে বের হতে হয়েছে। তবে শুধু যে মা বাবাই তাদের পছন্দকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশে মেধার অপচয় ঘটাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়াও এ ব্যাপারে অবদান রাখছে। ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে ফ্যাকাল্টি ভিত্তিক এবং সেখানে আবার বলা হচ্ছে এটা বা সেটা হচ্ছে টপ সাবজেক্ট। পৃথিবীর আর কোন দেশে এরকম টপ সাবজেক্ট বলা হয় কিনা আমার যানা নেই, এরকম ফ্যাকাল্টি ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা হয় কিনা সেটাও আমি নিশ্চিত নই। যাই হোক, অনেকে তাদের পছন্দের বিষয় না হলেও টপ সাবজেক্ট এ ভর্তি হচ্ছেন ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জন করায়, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায়। কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল হচ্ছে না, মন প্রাণ সপে দিতে না পারায়। অনেকে তাই পঠিত সাবজেক্টের সাথে সম্পর্কিত প্রফেশনে থাকছেন না। যারা থাকছেন তারা প্রফেশনাল জীবনেও মন প্রাণ সপে দিয়ে কাজ করতে পারছেন না।ফলে মেধার অপচয় হচ্ছে এখানেও।

অনেক সময় বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা অভিজ্ঞ লোকের পরামর্শের অভাবে অনেকে বিভ্রান্ত হয়। আমার এক আত্নীয় বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উভয় প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করার কারণে কনফিউজড হয়ে ছিল, কোথায় ভর্তি হবে। বন্ধুদের কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনে-টিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হতে। কারণ এটা নতুন সাবজেক্ট, অনেক কিছু আবিষ্কার করার সুযোগ আছে । অন্য দিকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রায় সব আবিষ্কার হয়ে গেছে। নতুন তেমন কিছু করার সুযোগ নাই। আমি প্রশ্ন করলাম, বায়োলজি পড়তে কেমন লাগে? বায়োলজি না ফিজিক্স কোনটা পড়তে ভাল লাগে? উত্তর যখন হল, বায়োলজি পড়াটা তেমন উপভোগ করে না, তখন আমি বলে দিলাম বায়োটেকনোলজি পড়ার দরকার নাই, বুয়েটেই পড়।তার সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হল।

আরেক খালাত ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করছেন । খালা কানাডায় অধ্যয়নরত বড় ছেলেকে বলেছেন অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যয়নরত আমার সাথে পরামর্শ করতে, কোন সাবজেক্ট এ ভর্তি হলে ভাল হবে যেহেতু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি বললাম, আমি কোন সাবজেক্টের নাম বলব না। কোন সাবজেক্টে পড়বে সেটা ওকেই ঠিক করতে দিতে হবে। ওর যদি বোটানি পড়তে ইচ্ছা করে ও বোটানিই পড়বে, ম্যাথ পড়তে ইচ্ছা হলে ম্যাথই পড়বে। তবে অনেক ভেবে চিন্তে ওকেই ঠিক করতে হবে ওর কোনটা পড়ার ইচ্ছা, কোন সাবজেক্ট ওর প্রিয়। ওর ইচ্ছা হল, কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার । তাই পড়ছে। কিন্তু মৃদু আপত্তি উঠেছিল আত্নীয়দের কারো কারোর তরফ থেকে। বড় ভাই কম্পিউটার পড়েছে, ছোট ভাই ও তাই পড়বে? যাই হোক, ও কম্পিউটার সায়েন্সেই পড়ছে, এবং ভালই করছে। প্রথম বছরের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। অন্য বিষয়ে পড়লে কি এরকম ভাল সে করতে পারত? না পারার সম্ভাবনাই বেশী। আর পারলেও অনেক মানসিক চাপ নিয়ে পড়তে হত, এরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারত না, ফলাফল ভাল হলেও মানসিক স্বাস্থ্য এত ভাল থাকত না। ফেসবুকে পরিচিত একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল পরামর্শ চাইলেন, এ লেভেল পাশ করা ছেলে কে কি পড়াবেন? আমার একই পরামর্শ, ওর যেটা পড়তে ভাল লাগে সেই বিষয়ে পড়তে দিন। যাই হোক, পরামর্শ তিনি শোনেননি। প্রথম সেমিস্টারে যখন ফলাফল আশানুরূপ হল না, তখন তিনি আমার পরামর্শের মর্ম বুঝলেন। ছেলেকে পছন্দ মত পড়তে দিলেন, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তবে মেধার এই অপচয় বুঝতে হলে আমাদের কে কিছু জানা বিষয়ের প্রতি আবার নতুন করে নজর দিতে হবে। সেটা হচ্ছে, আমাদের মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আলাদা, প্রতিটি মানুষই আলাদা।তবে শুধু ফিঙ্গার প্রিন্ট আলাদা নয়। প্রতিটি মানুষ আলাদা,আলাদা প্রত্যেকের চাওয়া, পাওয়া , ভাল লাগা, মন্দ লাগা, স্বপ্ন সাধ আর সাধ্য । আর আমাদের এই আলাদা হওয়াকে সম্মান করতে হবে , কথায় এবং কাজে।তা না করে আমরা যদি আমাদের পছন্দ, স্বপ্ন আমাদের সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেই, তার পরিণাম শেষ পর্যন্ত কারোর জন্য ভাল হয় না।

যেমন দরুন , আপনার ছোট বাচ্চা কোন খাবার খেতে পছন্দ করে না। সে খাবার তাকে খাওয়ানো কি সহজ? জোর করে খাওয়াতে গেলে কি অবস্থা হয় ? অন্য দিকে সে যদি কোন খাবার খুব পছন্দ করে, তা খাওয়ানোর জন্য কি আপনাকে কোন কসরত করতে হয়? ঠিক তেমনি আপনি যদি আপনার সন্তান কে তার ভাল লাগা অনুযায়ী পড়াশোনা করতে দেন, তবে তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে আপনার খুব একটা বেগ পেতে হবে না। ভাল লাগা খাবারের মত পড়াশোনাও সে করবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং চাকরী জীবনটাকেও উপভোগ করবে, সফলতা আসবে সহজে। আর যদি অপছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করে তবে আপনার চাপিয়ে দেওয়া অপছন্দের খাবার যেমন বিরক্তি সহকারে খায়,তেমনি পড়াশোনা আর প্রফেশনাল জীবনটাও হবে বিরক্তি কর। তাই আপনার সন্তান যদি তুলনামুলকভাবে খারাপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তার পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায়, তবে তাকে সেখানেই পড়তে দিন, ভাল প্রতিষ্ঠানে অপছন্দের বিষয় পড়তে না পাঠিয়ে।

আরেকটা বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার । তা হচ্ছে, মেধাবী লোক সমাজের সব পেশায় দরকার, শুধু ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ না। আর সৃষ্টিকর্তা মেধাবীদের সবাইকে সাইয়েন্স পড়ার জন্য , ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য মেধা দেননি। প্রত্যেককে তার ভাল লাগা, ভালবাসার সাথে মিলিয়েই মেধা দিয়েছেন । অন্যভাবে বলা যায়, তার মেধা মননের সাথে মিলিয়েই তার স্বপ্ন আর ভাল লাগা, ভালবাসা দিয়েছেন। তাই তার মেধা আর ভাল লাগার সমন্বয় করেই তাকে তার পেশা নির্ধারণ করতে দিন। আপনি যা হতে পারেননি তা তাকে বানাতে চাইবেন না বা আপনি তাকে যে পেশায় দেখতে চান সে পেশায় তাকে ঠেলে দিবেন না। তাকে তার মেধা আর পছন্দের সমন্বয়ে পেশা গড়ে তোলতে সহায়তা করুন। যদি আপনার ইচ্ছা আর তার পছন্দ মিলে যায়, তাহলে সোনায় সোহাগা। না মিললে তার পছন্দ কে মেনে নিন। দেখবেন, আপনার সন্তান আপনার মুখ উজ্জ্বল করেছে।

মনে রাখবেন এই পৃথিবীতে কোন পেশায় ছোট না আর মন প্রাণ সপে দিতে পারলে যে কোন পেশায় গর্ব করার মত অবস্থানে যাওয়া যায়। কিন্তু অপছন্দের খাবার যেমন তৃপ্তি করে খাওয়া যায় না, অপছন্দের বিষয় তেমনি মন দিয়ে পড়া যায় না, অপছন্দের পেশায় তেমনি মন প্রাণ সপে দিয়ে কাজ করা যায় না, উন্নতিও করা যায় না। আর চাপাচাপি করে কারোর ভাল লাগা, ভালবাসা বদলানোও যায় না।
তবে অনেক সময় অনেকেই যেমন ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে, তেমনি অনেকেই ভুল বিষয়ের প্রতি, পেশার প্রতি মুগ্ধ হতে পারে । তাই সন্তানকে মেধা আর ভাল লাগার সঠিক সমন্বয়ে সহায়তা করতে হবে। অনেকে সব বিষয়ে ভাল ফলাফল করতে পারে মেধার জোরে। কিন্তু সব বিষয় কারোরই সমান ভাল লাগে না।

তাই তাকে সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে উচ্চ শিক্ষার বিষয়, যা প্রকারান্তরে পেশার পথ নির্ধারণ, ঠিক করতে হবে। কেউ যদি তার ভাল লাগা/ পছন্দ নিয়ে দ্বিধাদন্ধে ভোগে, সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের মতামত নেওয়া যেতে পারে, বন্ধু বান্ধবদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। আরেকটা কথা, আপনি আপনার সন্তানকে কোন পেশায় দেখতে চান, সেটা প্রকাশ না করাই অনেক ক্ষেত্রে ভাল। কারণ, মা বাবার একান্ত অনুগত সন্তান নিজের ইউনিকনেস না বোঝার কারণে, ভাল লাগা, ভালবাসার গুরুত্ব না বোঝার কারণে এবং অবাধ্য হওয়ার ভয়ে অনেক সময় মা বাবার পছন্দকেই নিজের পছন্দ বলে ভুল করে সারা জীবন ভুক্তভোগী হয়। আমাদের শিক্ষিত লোকদের এ ব্যাপারে যে ভূমিকাটা রাখতে হবে, তা হচ্ছে এ ব্যাপারে কেউ যদি আমাদের কাছে পরামর্শের জন্য আসে, তাকে এই সাবজেক্ট বা ঐ সাবজেক্ট পড়লে ভাল হবে না বলে বলা উচিত তোমরা পছন্দ কোনটা, কোন সাবজেক্ট তোমার পড়তে ভাল লাগে, সব সময় কোন সাবজেক্ট এ ভাল নম্বর পেয়েছ, তার সাথে সম্পর্কিত কোন সাবজেক্ট পড়তে।

আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেধার অপচয় রোধে যা করতে পারেন, তা হচ্ছে ভর্তি প্রক্রিয়াকে এমন ভাবে সাজাতে পারেন যেন ১) ছাত্ররা কোন বিষয়কে টপ বিষয় না ভাবে, গর্বের বিষয় মনে না করে। তার ভাল লাগা, ভাল বোঝার বিষয়টাই তার জন্য টপ বিষয়, গর্বের বিষয়, হোক না সেটা বোটানি বা ফিজিক্স বা ম্যাথম্যাটিকস-এই মেসেজটাই তাকে দিতে হবে ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২। সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্র যেন তাদের পছন্দের বিষয় পড়তে পারে ভর্তি প্রক্রিয়াটা সেভাবেই সাজাতে হবে। সাবজেক্ট ভিত্তিক ভর্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং সর্বোচ্চ তিন বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে এবং তা হতে হবে একই ডিসিপ্লিনের। কেউ যদি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর বায়োলজির সাথে সম্পর্কিত তিন বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায়, বোঝতে হবে সে নিজের ভাল লাগা সম্পর্কে সচেতন না। তার মেধার অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই বিশ্ববিদ্যালয় গুলি ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং চালু করতে পারে পয়সার বিনিময়ে, সাইকোলজি আর বিজনেস ডিপার্টমেন্টের সাহায্যে। এতে একদিকে যেমন মেধার অপচয় রোধ হবে, অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু আয় হবে। শুধু বিশ্ব বিদ্যালয়ে না, স্কুল গুলিতেও চালু করা দরকার, যখন থেকে সাইয়েন্স, কর্মাস আর আর্টস আলাদা হয়ে যাচ্ছে , তখন থেকেই শুরু করা উচিত। মেধাবী হলেই কাউকে সাইয়েন্স পড়তে ঠেলে দেওয়া ঠিক না, দেখতে হবে সায়েন্সের প্রতি তার পেশান আছে কিনা, গবেষক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুসন্ধিতসা তার মধ্যে আছে কিনা।

সব কথার শেষ কথা, যত তাড়াতাড়ি আমরা মেধার অপচয় সম্পর্কে সচেতন হই তত ভাল। মেধার পাচারের চেয়ে মেধার অপচয় জনিত ক্ষতি কম না কিন্তু মেধার অপচয় রোধ তুলনামূলক ভাবে সহজ। এর জন্য আমাদের কে যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে , মা বাবা সহ সবাইকে সচেতন করতে হবে যে প্রত্যেক মানুষ আলাদা আর মানুষ যা করতে , পড়তে ভালবাসে, তাতেই সে ভাল করতে পারে। সবার জন্য ভাল বলে কোন বিষয় নেই। যে যেটা ভালবাসে ,সেটাই তার জন্য ভাল বিষয়, টপ বিষয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top