করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিক এর প্রায় এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল। এখনো আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে! উচ্চবিত্তের জন্য বরাদ্দ আছে ফাইভ-স্টার ক্যাটেগরির হাসপাতাল আর চার্টার বিমানে বিদেশ। কিন্তু বাকিদের কি অবস্থা?
দরিদ্র মানুষেরা জীবন আর জীবিকার টানাপোড়নে করোনা ভাইরাস নিয়ে খুব কমই ভাবার সুযোগ পাচ্ছে। আর মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটাছুটি করতে করতেই কারো কারো নিভে যাচ্ছে জীবন প্রদীপ। কোনভাবে যদি হাসপাতালে যায়গা জোটেও চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন সবার ফতুর হবার দশা। যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন তাদের অনেকেই লং-কোভিড জটিলতায় ভুগছেন। যার ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবারই নিঃস্ব হওয়ার পথে।
এই পরিস্থিতিতে আমার কাছে মনে হচ্ছে দেশে কোন প্রকারের Health Insurance বা স্বাস্থ্য-বীমা না থাকার ফলাফল কি হতে পারে আমরা তা দেখছি। বাংলাদেশে ইনস্যুরেন্স বলতে যা আছে এইটা মূলত জীবন বীমা অর্থাৎ মরার পর আপনার পরিবার কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে তার একটা আগাম ব্যবস্থ্যা। আর উন্নত দেশ গুলোতে ইনস্যুরেন্স বলতে মূলত বোঝায় আপনি জীবিত থাকাকালীন চিকিৎসা খরচ মেটানোর জন্য আপনি একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ দিবেন আর তারা আপনার সারা বছরে যত চিকিৎসা ব্যয় আসবে তার ৭০-৮৫ ভাগ দিয়ে দিবে। এবার আপনি চিকিৎসা যেখানেই নেন (দেশের ভিতর) আর যে রোগেরই নেন। উদাহরণ স্বরূপ আমার জন্য আমার ভার্সিটি বছরে আমার টিএ স্যালারির প্রায় ১০% ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে দেয় যেটা থেকে আমার চিকিৎসা ব্যয়ের সংস্থান হবে। খুব কম সময়ই আমার এটা কোন কাজে আসছে যেহেতু আমার বয়সীদের অসুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই যেমন এখন ভাইরাসের কারনে আমিও রিস্কে আছি। আবার যেকোনো সময়ে কোন ইমারজেন্সিতে চিকিৎসা নিতে যেতে হলে তখন এক সাথে যে পরিমান টাকা লাগবে সেটা কোথা থেকে আসবে? যার জন্য এই ব্যবস্থা। ইনস্যুরেন্স নেয়া সবার বাধ্যতামুলক। মাফ নাই। যার সামর্থ্য নাই তার জন্য আছে সরকারি খরচে ইনস্যুরেন্স যেটা এখানে মেডিকেইড নামে পরিচিত। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও পরিক্ষামুলকভাবে এই ব্যবস্থা চালু করেছে।
আমাদের দেশের অবস্থা বিবেচনা করলে এখনি সবার জন্য ইনস্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করা সম্ভব না। যারা দরিদ্র তাদের জন্য সরকারী হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। আর যারা সচ্ছল যেমন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী তাদের জন্য স্বাস্থ্য-বীমার ব্যবস্থা এই মুহূর্তে চালু করা সবচেয়ে উপযোগী। এতে করে তারা নিশ্চিন্ত মনে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। আর সরকারী হাসপাতেলেও তাদের জন্য আলাদা পেইড সার্ভিস রাখা যায় যেটা থেকে সরকারী হাসপাতালগুলোর আয় বাড়বে আর সেই সাথে সেবার মানও। সরকার প্রথমে সরকারী চাকরিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে পাইলট স্কেলে প্রথমে তাদের বেতনের ৫% কে প্রিমিয়াম হিসেবে কেটে রেখে এটা শুরু করতে পারে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি সরকারী বেসরকারি যেকোনো উদ্যোগেই হতে পারে। পরবর্তীতে এটা সারা দেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই ব্যবস্থা করা গেলে প্রচুর মানুষকে আর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হবে না। দেশের হাসপাতাল গুলোর সেবার মানও বাড়বে। হাসপাতাল এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাঝখানে সরকার থেকে সুশাসন নিশ্চিত করবে।
ভাইরাস আসার পর থেকে দেশের মিডিয়া গুলোতে অনেক কিছু নিয়েই আলাপ হতে দেখলাম কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনো কোন আলাপ আলোচনা হতে দেখলাম না। আমাদের আলোচনা এক বছর পরে এসেও এখনো প্রাথমিক পর্যায়ের ইস্যুগুলো নিয়েই হচ্ছে। সরকারী হাসপাতাল গুলো একদিকে যেমন বর্ধিত সংখ্যক রোগীর ভার নিতে পারছে না আবার তাদের সেবার মান নিয়েও আছে হাজারো প্রশ্ন। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা চিকিৎসা করানোর জন্য টাকা চাইবেন এটাকে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাবখানা এমন যে তারাও সরকারি হাসপাতালের মত ফ্রি চিকিৎসা দিবে! ভুক্তভোগী বা গ্রাহক যেভাবেই নিজেকে দেখেন, এইটার আলাপ তোলার কাজ আপনার নিজেরই। কারণ নিশ্চয় আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। সুতরাং আলাপ তুলুন। সবার জন্য চাই হেলথ ইনস্যুরেন্স। আপনার আওয়াজেই শুরু হবে নতুন উদ্যোগ!
Image source: https://www.citizen.org/article/single-payer-health-care-for-all/